দরজার কাছে এসে কিশোরের নাম ধরে ডাকল মুসা।
পরক্ষণেই শোনা গেল জবাব, রাফিয়ানের চাপা উত্তেজিত চিৎকার। তার পর-পরই কিশোরের কথা শোনা গেল। দরজার ওপাশেই রয়েছে ওরা।
ষোলো
ছিটকিনি খুলে দিল মুসা। পাল্লা খুলতেই এক লাফে বেরিয়ে এল রাফিয়ান, তার কাঁধে দুপা তুলে দিয়ে গাল চেটে দিল।
উহ! আরিহ্! আরে, ব্যথা পাচ্ছি! …আমার গাল কাটা! আর্তনাদ করে উঠল মুসা।
বেরিয়ে এল কিশোর আর জিনা।
হাসল মুসা, টর্চের আলোয় ঝিক করে উঠল তার ঝকঝকে সাদা দাঁত। তারপর, জিনা বেগম, মুক্তি পেয়ে কেমন লাগছে?
দারুণ! জবাবটা দিল কিশোর।
পাগল হয়ে উঠেছে রাফিয়ান, মুসাকে ঘিরে নাচছে, আর ঘেউ ঘেউ করছে! প্রতিধ্বনি কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।
আরে, এই, রাফি, থাম তো, বাপু! ধমক দিল জিনা। তুই একাই বেরিয়েছিস, নাকি আমরাও? থাম, থাম!
ঢুকলে কী করে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
অল্পকথায় সব বলল মুসা।
কুয়ার ভেতর দিয়ে…দড়ি বেয়ে নেমেছ! বিশ্বাস করতে পারছে ্না জিনা। তুমি মুসা আমান…ঘোড়াকে ভয় পাও…অথচ…
বিপদে পড়লে ভয়ডর ওর কোথায় চলে যায়! বাধা দিয়ে বলল কিশোর। তখন ওর মত দুঃসাহসী হয়ে উঠতে খুব কম লোককেই দেখেছি! মুসার দিকে ফিরল। আসল কথা বলো। ব্যাটারা কোথায়?
জানাল মুসা।
পালানো দরকার! ব্যস্ত হয়ে উঠল কিশোর। রিভলভার আছে। ব্যাটাদের কাছে। আবার এসে পড়ার আগেই ভাগব। কোন পথে বেরোব?
এসো, ডাকল মুসা। আগে আগে রওনা হলো।
কুয়াঘরে চলে এল ওরা। দড়ি দেখিয়ে বলল মুসা, ওটা ধরেই। বেরোতে হবে আবার।
আমি পারব না, বাবা! দুহাত তুলল জিনা। তাছাড়া রাফিয়ান…
পারতেই হবে, জোর দিয়ে বলল কিশোর। এছাড়া আর কোন পথ নেই। যাও, দেরি কোরো না। রাফিয়ান আপাতত এখানেই থাক, পরে সুযোগ করে এসে নিয়ে যাব।
আরেকবার দ্বিধা করল জিনা, তারপর এগিয়ে গিয়ে দড়ি ধরে মাথা ঢুকিয়ে দিল ফোকরে। তাকে বেরোতে সাহায্য করল কিশোর আর মুসা।
একসঙ্গে তিনজনে দড়ি ধরে ঝুললে ছিঁড়ে যাওয়ার ভয় আছে, তাই একজন একজন করেই চলল। জিনা মই ধরে সেকথা চেঁচিয়ে জানাতেই মুসাকে ঠেলে দিল কিশোর।
রাফিয়ানকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রেখে সব শেষে বেরোল সে। নিরাপদেই বেরিয়ে এল বাইরে, খোলা আকাশের নিচে।
আনন্দে ধেই ধেই করে নাচছে রবিন, চোখে পানি। মুসা আর কিশোরকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে ফেলল। কোন কিছু না ভেবেই
এগিয়ে গেল জিনার দিকে, লাফ দিয়ে সরে গেল জিনা। হা হা করে হেসে। উঠল মুসা। থামলে কেন, রবিন?
লাল হয়ে গেল রবিনের গাল, জিনাও লাল, দুজনেই লজ্জা পেয়েছে।
চলো, জলদি যাই, হাসিমুখে তাড়া দিল কিশোর। ব্যাটারা এসে পড়তে পারে, যে-কোন সময়ে!
প্রায় ছুটে পাহাড় ডিঙাল ওরা, ছোট্ট বন্দরে নামল। নৌকার কাছে। এসেই থমকে গেল; বুঝল, কেন নৌকা ফেলে গেছে শত্রুরা। দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা পোহায়নি, তার চেয়ে আরও অনেক সহজ কাজটা করেছে, দাঁড় দুটো নিয়ে গেছে।
এবারে কী করি! চিন্তিত হয়ে পড়ল কিশোর।
মুক্তির আনন্দ, উবে গেল, মুখ কালো হয়ে গেল সবারই।
জাহাজ আনতে গেছে, জিনা বলল। খুব তাড়াতাড়ি করবে ওরা। দাঁড় ছাড়া প্রণালী থেকেই বেরোতে পারব না, জেলেদের যে ডাকব সে উপায়ও নেই। এখান ক হাজার চেঁচামেচি করলেও ওদের কানে যাবে না, অনেক দূরে রয়েছে। তার মানে, লোকগুলোকে ঠেকাতে পারছি না আমরা!
চুপ! হাত তুলল কিশোর। ধীরে ধীরে বসে পড়ল একটা পাথরে। একটা আইডিয়া আসছে আমার মাথায়, চুপচাপ ভাবতে দাও! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়ে গেল তার।
নীরব হয়ে গেল সবাই। উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে, কী আইডিয়া আসছে তার মাথায়?
মনে হয় কাজ হবে, হঠাৎ ঘোর ভাঙল যেন কিশোরের। শোনো, ওদের ফেরার অপেক্ষায় থাকব আমরা। এসে কী করবে ওরা? সিঁড়িমুখের পাথর সরিয়ে নিচে নামবে। দরজাওয়ালা ঘরটায় যাবে; ভাববে, আমরা ওখানেই রয়েছি, সেজন্যেই যাবে। এখন কথা হলো, তার আগেই যদি কেউ একজন লুকিয়ে থাকি আশপাশে, যেই ঢুকল ব্যাটারা অমনি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিই? তারপর ওদের মোটরবোট নিয়ে চলে যেতে পারব খুব সহজে। কী মনে হয়?
আইডিয়াটা চমৎকার মনে হলো মুসার কাছে, কিন্তু জিনা আর রবিনের দ্বিধা রয়েছে।
আমাদের কাউকে আবার নিচে নামতে হবে, জিনা বলল। দরজাটা বন্ধ করে তার কাছেপিঠে লুকিয়ে থাকা গেলই না হয়। কিন্তু দুজন লোক যে একই সঙ্গে ভেতরে ঢুকবে, তার নিশ্চয়তা কী? আর যদি ঢোকেও, আমাদেরকে না দেখলে হুশিয়ার হয়ে যাবে ওরা। তখন ওদেরকে ভেতরে রেখে দরজা আটকানো খুব কঠিন হবে, চিতার ক্ষিপ্রতা দরকার। পারা যাবে কিনা, যথেষ্ট সন্দেহ আছে! যদি না পারি, তখন কী ঘটবে? আরও বিপদে পড়ব না? ওরা তখন উঠে এসে সব্বাইকে খুঁজে বের করবে।
তা ঠিক, চিবুক চুলকাল কিশোর। ধরা যাক, মুসা নিচে গেল, দরজা সময়মত আটকাতে পারল না, লোকগুলো উঠে এল আমাদেরকে খুঁজতে…আরেক কাজ করলেই তো পারি। লোকগুলো পাথর সরিয়ে নেমে গেলেই ওপর থেকে সিভিমুখ আটকে দেব আমরা পাথর দিয়ে। মুসা তাদের আটকাতে না পারলেও আমরা পারব।
তা হলে মুসারই বা যাওয়ার দরকার কী? রবিন প্রশ্ন করল।
তা হলে দরজাটা আবার আটকে আসবে কে? দরজা খোলা দেখলেই ছুটে ওপরে চলে আসবে ওরা, আমরা পাথর রাখারও সময় পাব না। তা ছাড়া, এখনই শিওর হয়ে যাচ্ছি কেন, মুসা ওদেরকে ঘরে বন্দি করতে পারবে না? আর সিঁড়িমুখ আটকানোর কথা বললাম, সেটা তত নিরাপদ নয়। নিচ থেকে ঠেলে দুজন শক্তিশালী শোক পাথর সরিয়ে ফেলতেও পারে। তারচেয়ে ঝুঁকিটা নেয়াই ভাল নয়?