গেছে! রবিন বলল। এবার?
গেছে, কিন্তু আবার আসবে, কিশোরের অনুকরণে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল মুসা-বোধহয় ধারণা হয়েছে, এভাবে চিমটি কাটলে ব্রেনটা ঠিকমত কাজ করে। নৌকাটা নিয়ে যায়নি যখন, পালাতে পারব আমরা। চলো, জিনা আর কিশোরকে মুক্ত করি।
ছুটে এল ওরা সিঁড়িমুখের কাছে। থমকে দাঁড়াল। পাথর ফেলে মুখ রুদ্ধ করে দিয়ে গেছে ব্যাটারা! প্রথমে মস্ত এক পাথরের চাই ফেলেছে, তার ওপর রেখেছে বড় বড় পাথর-নিচ থেকে ঠেলে খুলে যাতে কোনমতেই বেরোতে না পারে কিশোর আর জিনা।
এগুলো সরানো অসম্ভব! হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল মুসা। আমিও পারব না! অন্য কোন পথে ঢুকতে হবে। কিন্তু কোথায় পথ?
দাঁড়াও দাঁড়াও, হাত তুলল রবিন। টাওয়ারের কাছে আরেকটা মুখ আছে, নকশায় দেখেছি! চলো, দেখি, খুঁজে বের করা যায় কিনা!
ডান পাশের টাওয়ারের কাছে চলে এল দুজনে। টাওয়ার বলতে এখন আর কিছু নেই, খালি পাথর ভাঙা স্তূপ। একটু চেষ্টা করেই অসম্ভব। চেষ্টা বাদ দিল ওরা, এর মাঝে সিঁড়িমুখ খুঁজে পাওয়ার কোন আশা নেই, সময়ও নেই হাতে।
হায় হায়! কী করি এখন! মাথায় হাত দিল মুসা। কী করে বের করি ওদের! রবিন, তোমার মাথায় কিছু আসছে না?
কিচ্ছু না!
একটা পাথরের ওপর ধপ করে বসে গালে হাত রাখল রবিন। ভীষণ উদ্বিগ্ন। লাল, মুখ আরও লাল হয়ে উঠেছে। হঠাৎ উজ্জ্বল হলো তার চেহারা। মুসা, পেয়েছি! হাতে তুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। এক কাজ করতে পারি না? কুয়া দিয়ে নেমে যেতে পারি না? কুয়াটা সিঁড়িঘরের কাছাকাছিই আরেকটা ঘরের ভেতর দিয়ে গেছে। ফোকরও রয়েছে কুয়ার দেয়ালে। ওখান দিয়ে ঘরে বেরোতে পারি আমরা! পারি না? শুধু পাথরটাই একটা বাধা, ওটা কোনভাবে পেরিয়ে যেতে পারলেই হলো!
ভেবে দেখল মুসা। তক্ষুণি কোন মন্তব্য না করে রবিনকে নিয়ে চলে। এল কুয়ার পাড়ে। ভেতরে উঁকি দিয়ে ভাবল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, ঠিক বলেছ। পাথরের ফাঁক দিয়ে গলে নেমে যেতে পারব চেষ্টা করলে।
তা হলে আর দেরি কী? চেষ্টা শুরু করে দিই!
এখন মইটা ততদূর পর্যন্ত থাকলে হয়, তার আগেই যদি শেষ হয়ে যায় তো আর হলো না! রবিনের দিকে তাকাল মুসা। আমি চেষ্টা করে দেখি। তুমি থাকো এখানে। দুজনের ভার অনেক বেশি। মই ছিঁড়ে খসে পড়ে মরার ইচ্ছে নেই। রবিনকে বাধা দেয়ার সময় না দিয়ে মই ধরে, নামতে শুরু করল সে।
সাবধান, মুসা, খুব সাবধান! চেঁচিয়ে হুশিয়ার করল রবিন ওপর থেকে। আরে, শোনো, শোনো, দড়ি নিয়ে যাও! কাজে লাগতে পারে।
ঠিক, ঠিক বলেছ! থেমে গেল মুসা, উঠতে শুরু করল আবার। দৌড় দাও। নিয়ে এসো।
দড়ি নিয়ে এল রবিন।
আমার জন্যে ভেব না, হাসল মুসা। এসব ঝোলাঝুলি আমার অভ্যেস আছে, খুব ভাল করেই জানো। আর যেভাবেই হোক, হাত পিছলে পড়ে মরব না।
সাদা হয়ে গেছে রবিনের মুখ। উত্তেজনা আর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। দাঁড়াতে পারছে না, শেষে বসেই পড়ল একটা পাথরের ওপর।
রবিন, শুনতে পাচ্ছ? কুয়ার ভেতর থেকে ডাক শোনা গেল মুসার। আমি ঠিক আছি।
হ্যাঁ, মুসা, জবাব দিল রবিন। সাবধানে থেকো, ভাই, খুব। সাবধান! তাড়াহুড়ো কোরো না! মই কি আরও নিচে আছে?
তাই তো মনে হয়, অনেক নিচ থেকে এল মুসার জবাব। না না, আর নেই, শেষ! ভেঙে খসে গেছে, না এখানেই শেষ, বোঝা যাচ্ছে না। চিন্তা নেই, আমি দড়ি বাঁধছি।
নীরবতা, দড়ি বাধছে বোধহয় মুসা।
হ্যাঁ, তাই করছে গোয়েন্দা-সহকারী। দড়ির এক মাথা শক্ত করে পেঁচিয়ে বাধল মইয়ের একটা ডাণ্ডার সঙ্গে। তারপর ঝুলে পড়ল দড়ি ধরে। চেঁচিয়ে বলল, রবিন, দড়ি বেয়ে নামছি! ঠিকই আছি, ভেব না।
রবিন কিছু একটা বলল, কিন্তু বোঝা গেল না এত নিচ থেকে। নেমে চলল মুসা। নিয়মিত ব্যায়াম করে সে, কাজেই কাজটা সহজই তার জন্যে। অন্তত এখন পর্যন্ত, পরে কী হবে জানা নেই। যা হয় হোক গে, পরের ভাবনা পরে, আগে ফোকরটা খুঁজে বের করা দরকার।
অন্ধকারে কতক্ষণ নামল মুসা, বলতে পারবে না। একটা সময় মনে হলো, আর নামার দরকার নেই, ফোকরের কাছে পৌচেছে। এক হাতে দড়ি ধরে ঝুলে থেকে আরেক হাতে টর্চ নিয়ে জ্বালল। আলো ফেলে দেখল কুয়ার দেয়ালে। তার অনুমান ঠিকই। ঠিক মাথার ওপরে রয়েছে। ফোকর, ছাড়িয়ে নেমে এসেছে। টর্চটা জ্বলন্ত অবস্থায়ই দাতে কামড়ে ধরে আবার উঠতে শুরু করল সে। ফোকরের কাছে পৌঁছে ধারে পা বাধিয়ে দিল। দোল দিয়ে শরীরটাকে নিয়ে এল কুয়ার দেয়ালের কাছে। দক্ষ দড়াবাজিকরের মত শরীর বাঁকিয়ে-চুরিয়ে ঢুকিয়ে ফেলল ফোকরের ভেতরে। আর বেশি কষ্ট করতে হলো না, নেমে পড়ল ঘরের মেঝেতে। দড়ির মাথাটা মেঝেতে ফেলে তার ওপর একটা পাথর চাপা দিয়ে দিল, যাতে দড়িটা কোনভাবে ফোকর গলে বেরিয়ে ঝুলে না পড়ে কুয়ার ভিতরে।
একটা সুড়ঙ্গ-মুখের পাশের দেয়ালে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে এসে ভিতরে আলো ফেলল মুসা। হ্যাঁ, আছে, সুড়ঙ্গের দেয়ালেও রয়েছে চিহ্ন। ঢুকে পড়ল সে। সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আরেকটা ঘরে এসে ঢুকল। চেঁচিয়ে ডাকল জিনা আর কিশোরের নাম ধরে।
জবাব নেই।
খুঁজতে খুঁজতে আরেকটা সুড়ঙ্গ-মুখের পাশের দেয়ালে চক দিয়ে আঁকা চিহ্ন চোখে পড়ল! ঢুকে পড়ল মুসা, পেরিয়ে এল এই সুড়ঙ্গটাও। আরেকটা ঘরে ঢুকল। ওপাশের দেয়ালে বিশাল এক দরজা, দেখামাত্র চিনল সে। এটাই কুপিয়েছিল কিশোর, এই দরজার কাঠের চিলতে লেগেই গাল কেটেছে মুসার। দরজা বন্ধ, নিচে আর ওপরে বড় বড় ছিটকিনি, তুলে দেয়া হয়েছে।