না না, ঠিক আছে, আমরা কিছু মনে করিনি, মহিলার অপ্রতিভ। ভাব দেখে বলে উঠল রবিন। বিজ্ঞানীরা ওরকমই হয়, দুনিয়ার আর কোন খোঁজখবর থাকে না তো।
কথা পরে হবে, বললেন মহিলা। অনেক দূর থেকে এসেছ, সারাদিন কী খেয়েছ না খেয়েছ, কে জানে। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এসো। ওই যে, ওদিকে বাথরুম। আমি খাবার বাড়ছি।
খাওয়া সারা হলো, তবু জর্জের দেখা নেই।
ছেলেদেরকে থাকার ঘর দেখিয়ে দিলেন জর্জের মা। পাশাপাশি দুটো ঘর, একেক ঘরে দুটো করে বিছানা। লাল টালির ছাত, অনেক উঁচুতে। এক পাশের বড় বড় জানালা দিয়ে তৃণভূমি আর তার ওপারের জলাভূমি চোখে পড়ে। অন্য পাশের একটা জানালা দিয়ে সাগর দেখা যায়। বাতাসে জানালার কাঁচের শার্শিতে মাথা ঠুকছে রক্তগোলাপ। এত ফুল, খুবই ভাল লাগছে রবিনের।
জর্জ এখনও আসছে না! রবিন বলল।
ওর আসার ঠিকঠিকানা নেই, ঠোঁট বাঁকালেন মহিলা। হয়তো জেলেদের বাড়িতেই খেয়ে রাতদুপুরে আসবে। ওর বাপ জানলে তো দেবে পিট্টি, পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়বে। অনেক বুঝিয়েছি, রাগ করেছি, শাসন করেছি, শোনে না। ছেড়ে দিয়েছি এখন, যা খুশি করুক গে! বড় হলে যদি ভাল হয় তো হবে!
বড় করে হাই তুলল মুসা। শঙ্কিত হয়ে উঠল কিশোর আর রবিন, এরপর কী হবে বুঝতে পারছে। ওদের আশঙ্কাই ঠিক হলো। হা হা করে উঠলেন মহিলা, এই যে, ঘুম পেয়েছে! সারাদিন গাড়িতে, কম পরিশ্রম? শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো! কিশোর আর মুসাকে বললেন, তোমরা দুজন। এঘরে শোও। রবিন, তুমি ওঘরে চলে যাও..হ্যাঁ, রাতে কোন কিছুর দরকার হলে ডেকো আমাকে। একটুও লজ্জা কোরো না। আমি যাই।
গাধা কোথাকার! জর্জের মা চলে যেতেই মুসার দিকে চেয়ে ধমকে উঠল কিশোর। আর খানিকক্ষণ চেপে রাখতে পারলে না? ভেবেছি, খাওয়ার পর সৈকতে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসব। দিলে সব মাটি করে! কী করে মানা করি মহিলার মুখের ওপর? ভাববে বেয়াদব।
আমি…আমি বুঝিইনি! বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল মুসা। মহিলার রান্না খুব ভাল, বেশি খেয়ে ফেলেছি..তাই…
…তাই, আর কী? নাক ডাকিয়ে ঘুমাও এখন!
কিন্তু জর্জের ব্যাপারটা কী, বলো তো? রবিন কথার মোড় ঘোরাল। আমাদেরকে এভাবে দাওয়াত করে এনে…
আসবে সময় হলে, মুসা বলল। শুঁটকির ফাঁকিতে পড়িনি, এতেই আমি খুশি! ভেবে অবাক হচ্ছি, ছেলেটা কে!
এত দেরিতে হচ্ছ? রবিন পাল্টা প্রশ্ন করল। আমি তো চিঠি। পাওয়ার পর থেকেই ভাবছি, সে কে। কী করে আমাদের নাম জানল?
রহস্যজনক! গম্ভীর মুখে বলল কিশোর। নিশ্চয় আমাদের পরিচিত কেউ, কোন একটা মতলব আছে তার, হয়তো আমাদের সাহায্য দরকার।
হাঁ করে তাকিয়ে রইল রবিন আর মুসা, বুঝতে পারছে না।
এখন শুয়ে পড়ো, কাপড় ছাড়তে শুরু করল কিশোর। পরে জানা যাবে কী ব্যাপার। জর্জ আগে আসুক তো।
রাতে জর্জ কখন এল, কাপড় ছাড়ল, শুল, কিছুই টের পেল না। রবিন। ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে, সূর্য উঠেছে তখন।
চোখ মেলতেই লাল টালির ছাত চোখে পড়ল রবিনের। প্রথমে বুঝতেই পারল না কোথায় আছে। মাথা কাত করে জানালার দিকে তাকাল, ভোরের বাতাসে দুলছে গোলাপের ডাল, আলতো বাড়ি মারছে। শার্শিতে। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল তার, কোথায় রয়েছে। মুখ ফিরিয়ে আরেক পাশে তাকাতেই দেখল, অন্য বিছানাটাও এখন আর খালি নয়। কুকুরকুণ্ডলী হয়ে শুয়ে আছে একটা ছেলে, গলা পর্যন্ত চাদর টানা।
নড়েচড়ে উঠল ছেলেটা, চোখ মেলল, রবিনের দিকে তাকাল।
জর্জ? রবিন বল।
বিছানায় উঠে বসল ছেলেটা, আস্তে করে মাথা নোয়াল। মুসার চেয়েও ছোট করে ছাটা কালো চুল, মোটা নাক, রোদে-পোড়া চেহারা। কিন্তু চোখ দুটো বড় বড়, ধূসর, বাপের চোখের মতই তাতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ। চেহারাটা কেমন যেন পরিচিত মনে হলো রবিনের, আগে কোথাও দেখেছে, কিন্তু কোথায়, মনে করতে পারল না।
একটাও কথা না বলে উঠে গিয়ে বাথরুমে ঢুকল জর্জ। ভীষণ পেচ্ছাপ চেপেছে রবিনের, অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠল সে, কিন্তু জর্জের বেরোনোর নাম নেই। শেষে আর থাকতে না পেরে, পাশের ঘরে চলে এল। এখানেও বাথরুম খালি নেই, মুসা ঢুকেছে। কিশোরের বাথরুমের কাজ শেষ, চুল আঁচড়াচ্ছে।
আর পারছে না রবিন। জানালা দিয়েই কল ছেড়ে দেবে কিনা ভাবছে, এই সময় দরজা খুলল মুসা।
বারান্দায় বেরোতেই ডিম আর মাংসভাজার গন্ধ নাকে এল। আগে আগে চলেছে জর্জ, তিন গোয়েন্দার কারও সঙ্গেই কথা বলছে না, ফিরেও তাকাচ্ছে না। দাওয়াত করে এনে এ কেমন ব্যবহার?
ডাইনিং টেবিলে নাস্তা দিয়েছেন মিসেস গোবেল। কয়েকটা এঁটো প্লেট সরাচ্ছেন, বোধহয় খেয়ে উঠে গেছেন জর্জের বাবা।
জর্জের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলেন মহিলা। আরে, জর্জ, এ কী চেহারা করেছিস! চুলের এ অবস্থা করেছিস কেন? নাকে কী হয়েছে? বোলতা-টোলতা কামড়েছে?
না, সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে চেয়ারে বসে গেল জর্জ। এক টুকরো পাউরুটি তুলে নিয়ে তাতে মাখন লাগাতে শুরু করল। কারও দিকেই তাকাচ্ছে না।
স্থির চোখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন মিসেস গোবেল। শেষে মুখ বাঁকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তোর যা ইচ্ছে, করগে, আর কিছু বলব না! তোমরা বসো, বাবা, নিজের হাতে নিয়ে খাও। এটো। কাপপ্লেট তুলে নিয়ে সিঙ্কে ভেজাতে চলে গেলেন তিনি।