নীরবে জিনার গরম বক্তৃতা শুনল লোকটা, খুক করে হাসল। আমাদেরকে রুখতে পারবে বলে মনে হয় না! দুটো শিশু তোমরা, এত শক্তি আছে? এখন তো আরও ভাল হলো, দ্বীপ কেনার টাকাটাও বাচল। বারগুলো নিয়ে গিয়ে নৌকায় তুলব, তারপর জাহাজে করে নিয়ে হাওয়া হয়ে যাব। এই পচা দ্বীপ আর দুর্গ দিয়ে কী কচুটা করব? হাসল আবার সে।
পারবে না! এগিয়ে এসে দরজা আটকে দাঁড়াল জিনা। এখুনি বাড়ি গিয়ে বাবাকে সব খুলে বলছি…
মাই ডিয়ার বালিকা, বাড়ি আর যেতে পারছ না, বলল দ্বিতীয় লোকটা, জিনাম কাঁধে হাত রাখতে গেল, ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিল জি-ী। জোর করেই তার কাধ ধরে ঠেলে ভিতরে নিয়ে গেল লোকটা। তোমার ওই কুত্তাটাকে সরাও! নইলে গুলি করে মারব!
অবাক হয়ে দেখল জিনা, লোকটার হাতে বেরিয়ে এসেছে চকচকে বড়সড় একটা রিভলভার, রাফিয়ানের দিকে তাক করছে। থাবা দিয়ে তার হাত অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল জিনা, রাফিয়ানের গলার চামড়ার কলার ধরে টেনে সরিয়ে আনল। এই, রাফি, চুপ! চুপ কর বলছি! কিছু হয়নি!
হয়নি বললেই হলো? রাফিয়ান কি এত বোকা? ঠিকই বুঝেছে সে, ঘাপলা একটা হয়েছে। চুপ তো করলই না, গোঙানি আরও বাড়িয়ে দিল। ভয়ানক হয়ে উঠেছে চেহারা। জিনা ছেড়ে দিলেই গিয়ে এখন লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
গুড, বলল লোকটা। এভাবেই আটকে রাখো, ছাড়লেই মরবে। ওটা। তোমাদের ক্ষতি করার ইচ্ছে নেই আমাদের। কিন্তু একটু এদিক ওদিক করলেই..যা বলি, শোনো, মোটরবোটে করে এসেছি আমরা, কাজেই বারগুলো এখুনি নিয়ে যেতে পারছি না। একটা জাহাজ আনতে যাচ্ছি, ততক্ষণ তোমরা আটকে থাকবে এখানে।
তোমাদের আরও দুজন সঙ্গী আছে, বুঝতে পেরেছি। চেঁচিয়ে দুজনের নাম ধরে ডাকছিলে, বলল অন্য লোকটা। কয়েক ঘণ্টার জন্যে ওদেরও আটকে থাকতে হবে এখানে। ভয় নেই, খাবার আর পানি রেখে যাব, না খেয়ে মরবে না। এক কাজ করো তো, পকেট থেকে কাগজ কলম বের করল সে। ছোট্ট একটা নোট লিখে দাও। লেখো, সোনার বারগুলো পেয়েছ। ওপরে যারা আছে তারা যেন শিগগির চলে আসে। চিঠি নিয়ে যাবে কুত্তাটা। খবরদার, কোনরকম চালাকির চেষ্টা করবে না।
করব না। মহাখাপ্পা হয়ে উঠেছে জিনা, সেটা ঢেকে রাখতে পারছে না। চালাকিও করব না, কিছু লিখবও না। কী ভেবেছ? আমাদেরকে বন্দি করে রাখবে? আবার বারগুলো নিয়ে যাবে? সেটি হতে দিচ্ছি না কিছুতেই।
ভাল চাও তো লেখো, গর্জে উঠল রিভলভারধারী। নইলে প্রথমে গুলি করব কুত্তাটাকে।
ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল জিনা। শীত শীত করে উঠল গা, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যেন রক্তস্রোত। না, না, গুলি কোরো না! ফিসফিস করে বলল সে।
বেশ, তা হলে লিখে ফেলো, কাগজ-কলম বাড়িয়ে ধরল লোকটা।
আমি পারব না! ফুঁপিয়ে উঠল জিনা, মুখ ঢাকল দুহাতে।
বেশ, তা হলে মরুক তোমাব কুত্তামিয়া, রিভলভারের মুখ ঘোরাতে শুরু করল সে। শীতল কণ্ঠস্বর।
রাফিয়ানের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল জিনা, জড়িয়ে ধরে আড়াল করে রাখতে চাইল। না না, মেরো না, লিখছি! দাও, লিখে দিচ্ছি! কাঁপা হাতে কাগজ আর কলম নিয়ে লোকটার দিকে তাকাল সে, কী লিখব?
লেখো, আদেশ দিল ভারি কণ্ঠ, রবিন, মুসা, সোনার বারগুলো খুঁজে পেয়েছি আমরা। জলদি এসো। ব্যস, এই তো, আর কী?
নির্দেশমত লিখল জিনা। নাম সই করতে গিয়ে ভাবল এক মুহূর্ত, তারপর গোটা গোটা অক্ষরে লিখল: জরজিনা গোবেল। এই ইঙ্গিতটা যদি বুঝতে পারে দুজনে, তা হলে উপায় একটা হলেও হতে পারে, আর কিছুই করার নেই।
লোকটার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে একটানা গোঁ গোঁ করে চলেছে রাফিয়ান, জিনা মানা করছে বলেই, নাহলে কখন আক্রমণ করে বসত! চিঠিটা ভাজ করে তার কলারে আটকে দিল জিনা, আরেকবার লোক দুটোর দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছুটল।
জিনাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না রাফিয়ানের, কিন্তু মনিবের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু একটা রয়েছে, যাওয়াটাই উচিত বলে ধরে নিয়েছে সে। লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওপরে বেরিয়ে এল। বাতাসে নাক। তুলে গন্ধ শুকল, রবিন আর মুসার গন্ধ খুঁজছে। কোথায় ওরা?
মাটিতে গন্ধ পাওয়া গেল, যেখান থেকে হেঁটে গেছে মুসা আর। রবিন। গন্ধ শুঁকে শুঁকে অনুসরণ করে চলল রাফিয়ান। ছোট পাহাড়টার ধারে ওদের দেখতে পেল সে। ছুটে এসে দাঁড়াল কাছে। মুসা চিত হয়ে শুয়ে আছে, তার গালের ক্ষতটা লাল, তবে রক্ত পড়া থেমে গেছে।
রবিন পিছন করে বসে আছে, মুসাই আগে দেখতে পেল রাফিয়ানকে। আরে, রাফি! তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল সে। তুই একা। পাতালে অন্ধকারে ভাল্লাগছে না বলে চলে এসেছিস?
মুসা, রাফিয়ানের কলারের দিকে চোখ রবিনের, ওটা কী? কাগজ মুচড়ে লাগিয়ে দিয়েছে! …নিশ্চয় নোট-ফোট কিছু! জরুরি কোন খবর…
হাত বাড়িয়ে কাগজটা খুলে আনল সে, ভাজ খুলে পড়ল মুসাকে শুনিয়ে, সোনার বারগুলো খুঁজে পেয়েছি আমরা! জলদি এসো! …জরজিনা গোবেল! …জর-জিনা!
পেয়েছে! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। চলো চলো, দেখি! বসে আছ কেন?
কিন্তু রবিন উঠল না। চিঠিটার দিকে তাকিয়ে আছে, চিন্তিত।
কী ব্যাপার? আবার জিজ্ঞেস করল মুসা।
তোমার কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে না? শুধু জিনা লিখলেই তো পারত, কিংবা জিনা পারকার! জরজিনা গোবেল লিখতে গেল কেন? ব্যাপারটা কেমন জানি লাগছে আমার! কোন ধরনের ইঙ্গিত? হুশিয়ারি?