কাঠের দরজা আর তাতে মারা পেরেকগুলো ভালমত পরীক্ষা করল। কিশোর। পুরানো আমলের রড, চ্যাপ্টা মাথাওয়ালা পেরেক, তাতে লাল মিহি মরচে। আঙুল দিয়ে চুলে লাল হয়ে যায় আঙুলের মাথা।
তালার পাশে দরজায় কোপ বসিয়ে দিল সে। ঘ্যাচাৎ! আশা করেছিল ভেঙে যাবে, ভাঙল না। আবার কোপ মারল কিশোর। লোহার, পাতে বাড়ি খেয়ে পিছলে কাত হয়ে গেল কুড়ালের ফল, চড়াৎ করে কাঠের চিলতে উঠে গিয়ে সোজা গাথল মুসার গালে।
ও, বাবা গো, গেছি, গেছি! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। টান দিয়ে খসিয়ে ফেলল কাঠের চিলতে, ক্ষত থেকে দরদর করে রক্ত বেরিয়ে এল।
টর্চের আলোয় ক্ষতটা ভাল করে দেখল কিশোর, বলল, খুব লাগছে, না? সরি। যাও, ওপরে গিয়ে ভাল করে ধুয়ে ওষুধ লাগিয়ে নাও। রবিন, তুমিও যাও, ওকে সাহায্য করো।
আমিও যাই, উদ্বিগ্ন হয়ে বলল জিনা।
না, তোমার আসার দরকার নেই, কাটা জায়গা চেপে ধরে রেখেছে। মুসা। তুমি এখানেই থাকো, কিশোরকে সাহায্য করতে পারবে।
জিনা, কুড়াল বাড়িয়ে ধরে বলল কিশোর, কোপাও। দেখো, কিছু করতে পারো কিনা দরজার। আমি মুসাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
রাফিয়ানের দায়িত্বে জিনাকে রেখে সিঁড়িঘরের দিকে এগোল। তিনজনে।
কাঠের দরজাটাকে আক্রমণ করল জিনা, সব দোষ যেন ওটার, তাই শাস্তি দিচ্ছে। একটু পরেই ফিরে এল কিশোর। ইতিমধ্যে তালার চারপাশে মোটামুটি দাগ কেটে ফেলেছে জিনা।
কিশোর কুড়ালটা নিয়ে নিল জিনার হাত থেকে, কোপাতে শুরু করল। বেশিক্ষণ আর টিকল না কাঠ, খটাং করে তালাটা খুলে কাত হয়ে ঝুলে রইল এক পাশে। ধাক্কা দিতেই কড়মড় প্রতিবাদ তুলে যেন ঘুম ভাঙল দরজার মরচে ধরা কজার। টর্চ হাতে ঢুকে পড়ল দুজনে।
মাঝারি আকারের একটা গুহা, পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। পুরানো পিপে আর বাক্সের বদলে এখানে অন্য জিনিস রয়েছে। একধারের দেয়াল ঘেঁষে স্কুপ হয়ে রয়েছে হলদে রঙের ছোট ছোট ইটের মত কিছু।
একটা ইট তুলে নিল কিশোর। চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ, সোনা! খাঁটি সোনার বার! জিনা, অনেক টাকার সোনা এখানে!
চোদ্দ
জিনার মুখে কথা জোগাল না। চোখ বড় বড় করে সোনার স্তূপের দিকে চেয়ে আছে, বিশ্বাসই করতে পারছে না। বুকের ভিতরে হৃৎপিণ্ডটা অস্থির লাফালাফি জুড়েছে। কিশোরেরও প্রায় একই অবস্থা।
রাফিয়ানের উত্তেজিত চিল্কারে চমক ভাঙল ওদের। প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ করছে।
এই, রাফি, চুপ, চুপ! ধমক দিল জিনা, কিন্তু কুকুরটার দিকে চেয়ে নিজেই চুপ হয়ে গেল। এমন করছে কেন! কি ব্যাপার, মুসা আর রবিন আসছে?
ফিরেও তাকাল না রাফিয়ান, চিৎকারও থামল না।
দরজার কাছে এসে ডেকে জিজ্ঞেস করল জিনা, মুসাআ! রবিইন! তোমরা? জলদি এসো! সোনার বারগুলো খুঁজে পেয়েছি!
জবাব নেই।
রাফিয়ানের চিৎকার এখন চাপা গর্জনে রূপ নিয়েছে। ভীষণ চোখে তাকিয়ে আছে দরজার ওপাশের অন্ধকারের দিকে। কী রে, রাফি! …নাহ, মুসা আর রবিনকে দেখে ওরকম করার কথা না! এই, রাফি… কথা আটকে গেল তার।
অন্ধকার থেকে ভেসে এসেছে একজন মানুষের ভারি কণ্ঠস্বর, গুমগুম করে উঠল যেন বদ্ধ জায়গায়। বিচিত্র প্রতিধ্বনি তুলল পাথরের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে।
কে? কে ওখানে?
ভয়ে কিশোরের হাত খামচে ধরল জিনা। গুঙিয়েই চলেছে রাফিয়ান, ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে।
টর্চ নিভিয়ে দিয়েছে জিনা, ফিসফিস করে বলল, চুপ! চুপ, রাফি!
কিন্তু রাফি চুপ করল না।
দরজার ওপাশের ঘরের একটা সুড়ঙ্গ-মুখে জোরাল টর্চের আলো দেখা গেল। দরজা থেকে সরে যাওয়ার সময় পেল না কিশোর আর জিনা, আলো এসে পড়ল হঠাৎ ওদের ওপর, রাফির গোঙানিই এজন্যে দায়ী।
আরে, আরে! বলে উঠল ভারি কণ্ঠ। দেখেছ কারা? দুটো ছেলেমেয়ে! আমার দুর্গের ডানজনে তোমরা কী করছ?
আপনার দুর্গ! মানে? জিজ্ঞেস করল জিনা।
আমার দুর্গ মানে আমার দুর্গ, এটা না বোঝার কী হলো? আরও খুলে বলছি, এটা আমি কিনছিঃ কাগজপত্র তৈরি হতে যা দেরি।
লোকটার পাশে এসে দাঁড়াল আরেকজন। চুপচাপ এক মুহূর্ত দেখল জিনা আর কিশোরকে। জিজ্ঞেস করল, বারগুলো খুঁজে পেয়েছ বলে চেঁচাচ্ছিলে, কীসের বার? কী খুঁজে পেয়েছ?
বোলো না, ফিসফিস করে বলল কিশোর, কিন্তু চাপা রাখা গেল না কথাটা, ফাস করে দিল প্রতিধ্বনি। অনেক গুণ জোরাল হয়ে বার বার ঘুরেফিরে বলল: বোলো না! বোলো না!! বোলো না!!!
বলবে না? বলতে বলতে এগিয়ে এল ভারি কণ্ঠ।
দাঁত খিঁচিয়ে ধমক লাগাল রাফিয়ান, কিন্তু তাকে কেয়ারই করল না। লোকটা। সোজা এগিয়ে আসতে লাগল। দরজার কাছে এসে ভিতরে। আলো ফেলেই শিস দিয়ে উঠল বিস্ময়ে। জেরি! দেখো এসে! ডাকল সঙ্গীকে। ঠিকই বলেছিলে, সোনা আছে এখানে! পড়ে আছে, তুলে নিয়ে গেলেই হলো! এমন সুন্দর দৃশ্য জিন্দেগীতে দেখিনি!
ওগুলো সব আমার! রেগে উঠল জিনা। এই দ্বীপ আর দুর্গ আমার মায়ের; এখানে যা আছে, সব আমাদেরই। ওই সোনার বার নিয়ে এসে জমা করেছিল আমার নানার-নানার-বাবা, তারপরেই তার জাহাজ ডুবে গেছে। এই সোনা তোমাদের নয়, ছিল না কোনকালে, হবেও না। এখনি গিয়ে বাবা-মাকে সব খুলে বলব, দ্বীপ আর বিক্রি করবে না, তোমরাও কিনতে পারবে না। খুব তো চালাকি করেছ! বাবাকে ভাল মানুষ পেয়ে ফাঁকি দিয়ে ম্যাপটা নিয়ে গেছ, দ্বীপ কেনার ফন্দি এঁটেছ!