বাকি জীবন আটকে থাকতে হবে নাকি এখানে! বিড়বিড় করল মুসা।
জিনা আর রবিন চুপ, তাদের ভয় সংক্রমিত হয়েছে যেন কুকুরটার মাঝেও, সে-ও চুপ।
এখনই হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? সাহস দিল কিশোর। কোন না কোনভাবে বেরিয়ে যাবই। আ-আরে, ওটা কী!
সবাই তাকাল। ইটের তৈরি মস্ত এক চিমনির মত, ছাত থেকে নেমে এসে ঢুকে গেছে মেঝেতে।
আলো ফেলে দেখতে দেখতে বলে উঠল জিনা, আমি জানি কী ওটা! কুয়া! ওপর থেকে নেমে এসে মেঝে ভেদ করে চলে গেছে। পাতালে!
ঠিকই বলেছে সে। এগিয়ে এসে ঘুরে ঘুরে দেখল সবাই। কুয়ার দেয়ালে এক জায়গায় একটা জানালামত, একবারে একজনের বেশি মাথা। ঢোকাতে পারল না তাতে। হাত ঢুকিয়ে ওপর-নিচে আলো ফেলে দেখল। কিশোর, একেবারে নিচে কী আছে দেখা গেল না। পাথর ফেলে দেখল, কোন আওয়াজ নেই। বড় বেশি গভীর! অনেক ওপরে আবছা আলো, ছোট্ট একটা ফাঁক দিয়ে আসছে। কুয়ার যেখানে চ্যাপ্টা পাথরটা আটকে আছে; ওই যে, যেটাতে রাফিয়ান পড়েছিল; তারই ফাঁক দিয়ে আসছে। আলো, বুঝতে অসুবিধে হলো না।
হ্যাঁ, মাথা বের করে এনে বলল কিশোর, কুয়াই। সুবিধে হয়েছে। কুয়াটার কাছাকাছিই কোথাও আছে সিঁড়িঘর।
এ-ঘরটায় ফোকর বেশি নেই। একটা করে ফোকরে ঢুকে ওপাশ দেখে ফিরে আসতে লাগল কিশোর। তিন নম্বরটায় ঢুকে খানিকটা দেরি করল, ফিরে এল হাসিমুখে। পেয়েছি, এসো।
অন্ধকার পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওরা ওপরে, বাইরে, খোলা রোদে। মাথায়, কাঁধে সূর্যের আলো যেন অমৃতের পরশ বোলাল; ঠাণ্ডা বিশুদ্ধ বাতাস ঘন ঘন ফুসফুসে টেনে নিল ওরা, অকারণেই খিলখিল করে হাসল জিনা, তার হাসি সংক্রমিত হলো রবিন আর মুসার মাঝেও।
ঘড়ি দেখল কিশোর। আরিব্বাপ! সাড়ে ছটা বেজে গেছে। তাই। তো বলি, পেটে মোচড় দিচ্ছে কেন। চলো চলো, খেয়ে নিই। কী, সেকেণ্ড, আজ খিদে কোথায় গেল?
আরে, মিয়া, ক্ষুধা আর টুধা! মরেই তো যাব ভেবেছিলাম! মুক্তির আনন্দে খাওয়ার কথা ভুলে গেছে মুসা আমান!
আগুন জ্বেলে চায়ের জন্যে কেটলিতে পানি চাপিয়ে খোলা চত্বরেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। গায়ে লাগছে কুসুম গরম রোদ, আহ্, কী আরাম!
চা, বিস্কুট আর কেক দিয়ে বিকেলের নাশতা সারা হলো, সেই সঙ্গে কিছু রুটি আর পনিরও খেল। সাংঘাতিক পরিশ্রম গেছে। কিছুটা ভারি খাওয়ার দরকার ছিল। রাফিয়ানেরও খাওয়া ভালই হলো। জিনার গা ঘেষে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে। চোখ বন্ধ, কান লেপটে রয়েছে মাথার সঙ্গে। সোজা হয়ে মাটিতে বিছিয়ে আছে লম্বা লেজটা। অদ্ভুত প্রতিধ্বনি, তারপর পাতালে পথ হারিয়ে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে-ও। একবার। মাত্র গর্জে উঠেছিল প্রতিধ্বনিকে ভয় দেখানোর জন্যে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যেন শখানেক কুকুর একসঙ্গে গর্জে উঠেছিল; তারপর সেই যে চুপ করেছে রাফিয়ান, একটা গোঙানিও বেরোয়নি ওর গলা দিয়ে, যতক্ষণ পাতালে ছিল।
আটটা পর্যন্ত শুয়ে রইল ওরা। সূর্য ডুবছে। গরম রোদ আর নেই, ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে।
উঠে বসল, কিশোর।
কী হলো? জিজ্ঞেস করল জিনা। আবার ঢুকছি নাকি আজ?
নাহ, মাথা নাড়ল কিশোর। আজ আর না। কাহিল লাগছে। চলো, ঘরে গিয়ে শুই।
ঘরে এসে বিছানা পাতল ওরা। রাতের খাওয়ার ঝামেলায় আর গেল না। সটান শুয়ে পড়ল যার যার বিছানায়। শোয়ামাত্রই ঘুম।
ভোরে রাফিয়ানের ঘেউ ঘেউ ডাকে ঘুম ভাঙল ছেলেদের। দরজার কাছে একটা খরগোশ ছিল, ওটাকে দেখেই ধমকে উঠেছে কুকুরটা। তাড়া করতে গেল, ডেকে তাকে ফেরাল জিনা।
ঘুম ভাঙতেই প্রথমে পাতালের বড় কাঠের দরজাটার কথা মনে। পড়ল কিশোরের। কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে ভাঙতে হবে ওটা। কী আছে অন্য পাশে, দেখা দরকার।
পেট ভরে খেয়ে নিল ওরা। সারাদিন আর খেতে পারবে কিনা, খাওয়ার সময় আর সুযোগ পাবে কিনা, জানে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আজ একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না। সোনার বারগুলো থেকে থাকলে, ওগুলো খুঁজে বের করবেই।
কুড়াল তুলে নিল কিশোর। আগে আগে চলল। তার পিছনে অন্যরা। সবার পিছনে রয়েছে রাফিয়ান। কোথায় যাচ্ছে, বুঝতে পারছে; সেজন্যেই মনমরা। আবার গিয়ে পাতালের অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঢোকার কোন ইচ্ছেই নেই তার। ভাবছে বোধহয়: কেন, বাপু; এই রোদ, এই আলো, এই খরগোশ তাড়া করার দুরন্ত মজা ছেড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি একটা অন্ধকার গুহায় ঢোকা! তা-ও আবার যে-সে গুহা নয়, কথা বললেই ধমকে ওঠে শতকণ্ঠ! কিন্তু জিনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ করার সাহস বা ইচ্ছে কোনটাই নেই তার।
অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে আবার সিঁড়িঘরে নেমে এল ওরা। বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় সেই ফোকরটা খুঁজে পেল, যেটা দিয়ে কাঠের দরজাওয়ালা ঘরটায় ঢোকা যায়।
আবার পথ হারাব আজ! জিনার কণ্ঠে অস্বস্তি। কী যে অন্ধকার! সব কটা ফোকর আর ঘর যেন এক রকম! কোটা থেকে কোটা আলাদা, বোঝার জো নেই।
কম্পাস আনলেই অনেক সহজ হয়ে যেত! বলল কিশোর। কিন্তু আনিনি যখন, ভেবে আর কী হবে? সাবধান থাকতে হবে, এই আর কী।
কম্পাস আনেনি বটে, কিন্তু আজ চক নিয়ে এসেছে কিশোর। যে পথেই যাচ্ছে, পাশের দেয়ালে খানিক পর পরই বড় করে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন একে একে এগোচ্ছে। কুয়াঘরটা খুঁজে পেয়েছে, ফোকরের পাশের দেয়ালে কয়েকটা আশ্চর্যবোধক এঁকে দিয়েছে। এবার আর পথ হারানোর ভয় নেই, ফিরে এসে এই ঘরটায় ঢুকতে পারলেই আর ভয় নেই, কারণ এর কাছাকাছিই রয়েছে সিঁড়িঘর, পাওয়া যাবেই।