এসো, সবাই ধরো।
দড়ি ধরল সবাই।
মারো টান! হেঁইও! …জোর সে মারো! হেঁইও!
সম্মিলিত শক্তির কাছে হার মানল পাথর। ছিপাত করে বিচিত্র শব্দ তুলে মাটির আকর্ষণ থেকে মুক্ত হলো ওটা। এর পরের কাজ সোজা। টেনে প্রবেশমুখ থেকে ঢাকনা সরিয়ে ফেলল ওরা।
একই সঙ্গে হুড়োহুড়ি করে এসে গর্তটার চারপাশ ঘিরে দাঁড়াল সবাই, নিচে উঁকি দিল। ধাপে ধাপে পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে।
যাক, পাওয়া গেল! বলল কিশোর। চলো এবার, নামি।
পিচ্ছিল সিঁড়ি, সবার আগে বুঝল সেটা রাফিয়ান। লাফিয়ে নামতে গিয়েই পা পিছলাল, হড়াৎ করে নেমে চলে গেল কয়েক ধাপ, ওলটপালট খেয়ে শেষে থামল এক জায়গায়, উঠল কোনমতে। কুঁই কুঁই করছে। ভয়ে। আর নামতে সাহস পাচ্ছে না।
সাবধান হয়ে গেল অন্যেরা। ধীরে ধীরে নেমে চলল। দুরুদুরু করছে বুক। ডানজন তো পাওয়া গেল, সোনার বারগুলো পাওয়া যাবে তো! কতগুলো আছে? ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরো মেঝেতে?
বাঁক নিল সিঁড়ি। অন্ধকার বাতাসে ভেজা কেমন একটা ভাপসা গন্ধ। শ্বাস নিতে সুবিধে হয়।
ইঁহ! দম আটকে আসে! জিনা নাক দিয়ে খোতখোত করল।
তাও তো ভালই এখানে বাতাস, কিশোর বলল, আরও নিচে কেমন, কে জানে! কুয়া কিংবা পাতালের বদ্ধ ঘরগুলোতে নানারকম বিষাক্ত গ্যাস জমে থাকে। ফুসফুসে ঢুকলে মরণ!
নীরবে নেমে চলল ওরা। যখন ভাবতে শুরু করেছে, এই সিঁড়ির আর শেষ নেই, ঠিক তখনই শেষ হলো সিঁড়ি। চারপাশে আলো ফেলে দেখল কিশোর। রোমাঞ্চকর দৃশ্য! জায়গায় জায়গায় পাথর পড়ে রয়েছে। একটা গুহা; প্রাকৃতিক, না মানুষের খোঁড়া, বোঝা গেল না। রহস্যময় অন্ধকার সবখানেই।
ইয়াল্লা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ফাঁপা এক ধরনের আওয়াজ উঠল বদ্ধ জায়গায়, দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল : লা-লা লা-লা-লা…! জ্যান্ত একটা শব্দের সাপ যেন বিচিত্র শব্দ তুলে পাক খাচ্ছে ওদেরকে ঘিরে, দেখা যায় না, অনুভব করা যায় যেন, হাত বাড়ালেই বুঝি ধরা যাবে! গায়ে গা ঘেষে এল ছেলেরা।
আশ্চর্য! ভয়ে ভয়ে নিচু গলায় বলল জিনা। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনি উঠল, খুব আস্তে, ফিসফিস করে পাক খেতে শুরু করল যেন এবার শব্দের সাপরের হাত খামজঙ্গে পরিচয় নেন
কিশোরের হাত খামচে ধরল জিনা। কাঁপছে। রক্ত জমেছে মুখে। এই ধরনের প্রতিধ্বনির সঙ্গে পরিচয় নেই তার, কিন্তু তিন গোয়েন্দার অভিজ্ঞতা আছে। টেরর ক্যাসলের প্রতিধ্বনি এর চেয়েও ভয়াবহ ছিল!
বারগুলো কোথায়? নিচু গলায় বলল মুসা, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনি উঠল: কোথায়! কোথায়! কোথায়!
হেসে উঠল কিশোর, তার হাসিকে লুফে নিয়ে শত-সহস্ৰভাগ করে বিচিত্র শব্দে যেন আবার তার দিকে ছুঁড়ে দিল রহস্যময় গুহা। চুপ হয়ে গেল সে। আস্তে বলল, এসো, আর কোথাও চলে যাই! এ-জায়গাটা ভাল না!
ভাল না! ভাল না! ভাল না!–প্রতিধ্বনি হলো।
সিঁড়ির কাছ থেকে সরে এল ওরা। দেয়ালে বড় ফোকর, বোধহয় দরজা। একটা ফোকর দিয়ে ঢুকে অন্য পাশে চলে এল ওরা, আরেকটা ঘরে, এটাকেও গুহা বলা যেতে পারে। এগুলো কী কাজে ব্যবহার হত? নিশ্চয় কয়েদী আটকে রাখার জন্যে, অনুমান করল কিশোর। বিড়বিড় করল, কিন্তু বারগুলো কোথায়? পকেট থেকে ম্যাপ বের করে মাটিতে বিছিয়ে তাতে টর্চের আলো ফেলল। বারগুলো কোথায় আছে, স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে বটে ম্যাপে, কিন্তু এই পাতালের ঘরে কোনটা যে-কোন্ দিক, বোঝার উপায় নেই। ইস, একটা কম্পাস নিয়ে আসা উচিত ছিল, আফসোস করল গোয়েন্দাপ্রধান।
মনে হয়… চোখ তুলল কিশোর হঠাৎ, এ-ঘরের আশপাশেই কোথাও রয়েছে! ওই যে, আরেকটা দরজা, হয়তো তার ওপারেই…আমি শিওর, ওখানেই আছে!
তেরো
একসঙ্গে চারটে টর্চ ঘুরে গেল দরজার দিকে। ভারি কাঠের পাল্লা লাগানো, বড় বড় পেরেক গেঁথে আটকে দেয়া হয়েছে, যাতে সহজে না খোলা যায়। হাসি ফুটল মুসার মুখে, ছোট্ট একটা কাশির মত শব্দ করেই ছুটে গেল দরজার কাছে। ঠেলা দিয়ে, থাবা মেরে, ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা করল।
কিন্তু বেশ ভাল করেই আটকানো হয়েছে দরজা। নড়লও না। চাবির ফোকর এত বড়, আঙুল ঢুকে যায়, চাবি নিশ্চয় আঙুলের মতই মোটা ছিল। কয়েক মুহূর্ত বোবা হয়ে দরজা আর তালার ফোকরের দিকে চেয়ে রইল ছেলেরা। এখন কী করবে? কী করে খুলবে ওই দরজা?
কুড়াল! নীরবতা ভাঙল কিশোর। কুড়াল আনতে হবে! কুপিয়ে ভেঙে ফেলব তালা!
ঠিক বলেছ! সায় দিল মুসা। চলো, গিয়ে নিয়ে আসি! তর সইছে না আর তার।
কিন্তু ফিরতে গিয়ে বুঝল ওরা, পথ হারিয়ে ফেলেছে। বিশাল ঘর, গোল দেয়াল, তাতে বড় বড় অসংখ্য ফোকর, সবগুলোই দেখতে প্রায় এক রকম; কোনটা দিয়ে ঢুকেছিল, বলতে পারবে না। অনুমানে একটা ফোকরে ঢুকে পড়ল। বেরিয়ে এল একটা ঘরে। সিঁড়িঘর নয় এটা। বড় বড় কাঠের পিপে ভেঙে-চুরে পড়ে আছে, কাঠপচা গন্ধ। নানা ধরনের খালি মদের বোতল স্তূপ হয়ে পড়ে আছে ঘরের কোণে। আর কয়েকটা টুকিটাকি ভাঙা জিনিস পড়ে রয়েছে এদিক-ওদিক।
বিচ্ছিরি! নাক কোঁচকাল কিশোর।
আবার আগের বড় ঘরটায় ফিরে এল ওরা। আরেকটা ফোকর দিয়ে। ঢুকল। কিন্তু সিঁড়িঘর পাওয়া গেল না, তার বদলে আরেকটা গোল ঘর। নানারকম বাতিল জিনিস, আর পচা ভাপসা গন্ধ।
একের পর এক ফোকর দিয়ে ঢুকল ওরা, বেরোল, কিন্তু প্রতিবারেই নতুন আরেকটা ঘরে ঢুকছে। সিঁড়িঘর পাওয়া যাচ্ছে না।