হাউমাউ করে কেঁদে উঠল জিনা। বিলাপ শুরু করল, ও, রাফি, রাফি রে, তুই কোথায়! …তোকে ছাড়া যে আমি বাঁচব না রে, রাফি…
জিনার কাণ্ড দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, মুসা আর রবিন। কিশোর মৃদু ধমক লাগাল, আরে, কী করছ, পাগলের মত! দাঁড়াও না দেখি আগে, তোলার ব্যবস্থা তো করতেই হবে। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে রাফিয়ান!
হিউউউ করে নাকি গলায় কেঁদে উঠল রাফিয়ান, সে যে বেঁচে আছে সেটা বোঝানোর জন্যেই, অনেক দূর থেকে ভেসে এল শব্দটা, কুয়ার নিচেই আছে।
মুসার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল কিশোর। যাও তো, এক দৌড়ে গিয়ে খোন্তা নিয়ে এসো। কুয়ার মুখ আরও বড় করতে হবে। তারপর দড়ি বেঁধে নেমে যাব।
সহজেই পরিষ্কার করা গেল গর্তের মুখ। ঝোঁপঝাড়ের শেকড় গর্তের দেয়াল ভেদ করে ঠেলে বেরিয়ে আছে; তার ওপর পাতা, আলগা মাটি জমে ঢেকে গিয়েছিল মুখটা। ওগুলো সরাতেই দেখা গেল বড় একটা পাথর, প্রায় ঢেকে দিয়েছে কুয়ার মুখ, এক ধারে সামান্য ফাঁক, ওই ফাঁক দিয়েই ভেতরে পড়েছে রাফিয়নি।
সবাই মিলে প্রচুর কায়দা-কসরৎ করে পাথরটা সরাল কুয়ার মুখ থেকে। তলায় কাঠের আরেকটা ঢাকনা। বোঝা গেল, টাওয়ার ধসে পড়ার সময় কোনভাবে গড়িয়ে এসে পাথরটা পড়েছিল মুখে, কিন্তু নিচের ঢাকনাটা মাপমত তৈরি করে বসানো হয়েছে, পানিতে যাতে কোন কিছু না পড়তে পারে সেজন্যে। ভিজে পচে গেছে কাঠ; এত নরম, রাফিয়ানের ভারও সইতে পারেনি, গোলমত একটা ফোকর হয়ে আছে।
নিচে উঁকি দিল কিশোর, তল দেখা যায় না। অন্ধকার। পাথর ফেলল, কিন্তু ছলাত করে উঠল না, কোনরকম আওয়াজই শোনা গেল না। তা হলে কি পানি নেই? নাকি পানি এত গভীরে, পাথর পড়ার আওয়াজ মাঝপথেই মিলিয়ে গেছে?
সাংঘাতিক গভীর মনে হচ্ছে! বিড়বিড় করে বলল কিশোর। কিন্তু রাফিয়ান…কোথায় ও?
টর্চের আলো ফেলল ভেতরে। অনেক কাল আগে মস্ত আরেকটা পাথরের চাঙর পড়েছিল ভেতরে, কুয়ার এক জায়গায় দেয়ালের ঘের সরু, ওখানে আটকে আছে। ওখানেই বসে আছে বেচারা রাফিয়ান; জিভ বের করে বড় বড় চোখ মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওপর দিকে। যেন বুঝতেই পারছে না, কী করতে কী ঘটে গেছে, কী হয়েছে ওর।
কুয়ার দেয়ালে আটকানাে রয়েছে লােহার মই। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নেমে পড়ল মুসা, লােহার মই বেয়ে নেমে চলল নিচে-ভাবেইনি বােধহয়, পুরানাে মই যে-কোন মুহূর্তে খসে আসতে পারে দেয়াল থেকে। মই বেয়ে তরতর করে নেমে চলেছে সে। নিরাপদেই কুকুরটার কাছে পৌছল, অনেক চেষ্টায় কাঁধে তুলে নিল ভারি রাফিয়ানকে, ধীরে ধীরে উঠে আসতে শুরু করল।
ওপরে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে বন্ধুরা, মুসা কাছাকাছি আসতেই তার কাধ থেকে কুকুরটাকে তুলে আনল ওরা, তারপর হাত ধরে মুসাকে উঠতে সাহায্য করল। ধপ করে বসে পড়ে হাঁপাতে শুরু করল মুসা।
মুসা, আন্তরিক প্রশংসা করল কিশাের, তুমি যে আমার বন্ধু, এজন্যে গর্বে আধ হাত ফুলে যাচ্ছে আমার বুক।
জিনা কিছু বলতে পারল না, কৃতজ্ঞ জল-টলােমলাে চোখে তাকিয়ে আছে মুসার দিকে।
‘সেকেণ্ড, একটা কাজের কাজই করেছ!’ রবিন বলল। তুমি দুর্দান্ত সাহসী! মই যে-কোন সময় খসে যেতে পারত, তারপর কী ঘটত সেটা জেনেও…’
খাইছে রে! ও, আল্লা!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। সেকথা তাে ভাবিইনি!’ চোখে আতঙ্ক ফুটেছে তার। একেবারে শুয়ে পড়ল। বাবা গাে, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি!’
হাে হাে করে হেসে উঠল সবাই। রাফিয়ানও তার কুকুরে-হাসি হেসে গাল, চেটে দিল মুসার।
খেঁকিয়ে উঠল মুসা, ‘দুত্তেরি, কুত্তার বাচ্চা! এখন এসেছে সােহাগ করতে! দিয়েছিলি তাে আরেকটু হলে! …যা, যা এখান থেকে! ভাগ!’
মুসার এই হঠাৎ পরিবর্তনে ভড়কে গেল রাফিয়ান, এক লাফে পিছিয়ে এসে বােকা বােকা চোখে চেয়ে রইল। বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন, খানিক আগে বাঁচিয়েছে তাকে ওই মারমুখাে ছেলেটা।
আবার হেসে উঠল সবাই।
জিনা ডাকল, ‘রাফিয়ান, এদিকে আয়! দুষ্ট ছেলে, আর খরগােশ তাড়া করবি?’ একটা ডাল ভাঙতে শুরু করল সে।
কী ঘটবে বুঝে গেল রাফিয়ান, দুই লাফে এসে জিনার একেবারে পায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ল। ডাল আর ভাঙা হলাে না, হাত তুলল জিনা, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওঠ, এইবার মাপ করে দিলাম। এরপর…’ হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে।
আবার ডানজনের প্রবেশপথ খোঁজায় মন দিল ওরা। ঝােপ কেটে সাফ করে খোন্তা দিয়ে খুঁচিয়ে চল ওগুলোর গোড়ায়। মাঝেমধ্যে ঠনন করে পাথরে বাড়ি লাগছে খোন্তা, খুড়ে বের করে আনছে ওটা। সাবধানে রয়েছে, রাফিয়ানের মত আলগা মাটির আস্তর ধসে না আবার গর্তে পড়ে। উত্তেজনায় ঘামছে দরদর করে।
হঠাৎই আবিষ্কার করে ফেলল রবিন। নিতান্তই ভাগ্য বলতে হবে। পরিশ্রান্ত হয়ে খানিক জিরিয়ে নেয়ার জন্যে শুয়ে পড়েছিল সে, শুয়ে শুয়েই মাটি খামচাচ্ছিল। বালির তলায় ঠাণ্ডা কিছু আঙুলে ঠেকল তার। কৌতূহল হলো, উঠে বসে বালি সরাতেই দেখা গেল, লোহার একটা মোটা রিং!
এই এদিকে এসো তোমরা! ডাকল সে। দেখে যাও!
রিংটা কীসে আটকানো, বালি পরিষ্কার করতেই তা বোঝা গেল। চারকোনা একটা পাথরের চাঙড়। নিশ্চয় প্রবেশপথের মুখে ঢাকা দেয়া রয়েছে।
নতুন উদ্যমে এটাকে সরানোর কাজে লেগে গেল ছেলেরা। বহু টানাটানি করল, কিন্তু এক চুল নড়ল না ভারি পাথর। মুসার প্রচণ্ড শক্তিও বিফল হলো। ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোর পাশার, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়েছে। হবে, হবে, দৃড়াও! আচমকা ধ্যান ভাঙল তার। দড়ি কয়েক পাক করে পেঁচিয়ে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল রিঙে, শক্ত করে বাঁধল।