লোহার রিং কিংবা হাতল-টাতল কিছু তো থাকার কথা, রবিন বলল। এসো তো, আরেকবার দেখি।
একবার নয়, আরও কয়েকবার দেখল ওরা। প্রতিটি ফাঁকে খোন্তার মাথা ঢুকিয়ে জোরে চাড় দিয়েও দেখল কিশোর আর মুসা, আলগা পাথর পাওয়া গেল না। ঝাড়া তিনটি ঘণ্টা একনাগাড়ে পরিশ্রম করল ওরা, লাভ হলো না। খিদেয় চো চো করছে পেট।
খেতে বসল ওরা। খেতে খেতেই আলোচনা চলল।
আর কীভাবে দেখব? কিশোর বলল। মনে হচ্ছে এঘরে নেই। দেখি, খেয়ে উঠে আরেকবার দেখব ম্যাপটা। অন্য কোন ইঙ্গিত আছে কিনা, কে জানে!
আরেকবার খুঁটিয়ে দেখা হলো ম্যাপ, নতুন কিছু বোঝা গেল না। নকশাটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর, চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে, গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে। দেখো, ম্যাপে আঙুল রাখল সে হঠাৎ, এই চিহ্নটা, এটাকে সিঁড়ি ভাবছি আমরা, তা না-ও তো হতে পারে? আর এই যে, কুয়ার মুখ, এটা এই চিহ্নের খুব কাছাকাছি। মানে কী? সিঁড়ির মুখ তো খুঁজে পেলাম না, চলো, কুয়ার মুখ খুঁজি। ওটা পেলে হয়তো সিঁড়ির মুখ খুঁজে বের করে ফেলতে পারব।
হয়তো, জিনা বলল। কুয়াটা আশপাশেই কোথাও…এই যে চত্বর, এরই কোথাও রয়েছে, ম্যাপের একটা জায়গায় আঙুল রেখে বলল সে।
বাইরে উজ্জ্বল রোদে বেরিয়ে এল ওরা। দুর্গের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এসে আশপাশে তাকিয়ে কুয়ার মুখ খুঁজল। শেওলা, ঘাস আর ঝোঁপঝাড়ের জন্যে চত্বরের পাথরই দেখা যায় না ভালমত, কুয়ার মুখ দেখবে কী? জায়গায় জায়গায় পাথর ফেটে ভেঙে বেঁকাতেড়া হয়ে গেছে, এককালে সমতল, মসৃণ ছিল, এখন হয়েছে তার উল্টো।
বড় একটা খরগোশ যেন ফুসমন্তরের বলে উদয় হলো চতুরে, কোথা থেকে উঠল ওটা, বোঝা গেল না। লাফিয়ে গিয়ে খানিক দূরের একটা, গর্তে সুড়ৎ করে ঢুকে পড়ল। আরেকটা খরগোশ বেরোল, এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েদেরকে দেখল, তারপর ওটাও গিয়ে ঢুকল। আগের গর্তটায়।
খানিক পরে আরেকটা খরগোশ বেরোল, বাচ্চা। বড় বড় কান, ছোট্ট লেজ, মনে হয় যেন গোড়া থেকে কাটতে গিয়ে ভুল হয়ে গেছে, আটকে রয়েছে খানিকটা। খোশমেজাজে তিড়িং-বিড়িং করে এলোপাতাড়ি কয়েক লাফে ছেলেদের কাছাকাছি চলে এল ওটা, বসে পড়ে কৌতূহলী চোখে। তাকাল, সামনের দুই পা দিয়ে কান ঘষছে, যেন ময়লা ধুয়ে ফেলছে।
খরগোশের বাচ্চার এই চালিয়াতি আর সইতে পারল না রাফিয়ান, হুউক! করে ধমক লাগিয়েই তাড়া করল। কল্পনাই করেনি, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁড় ওই অত্তোটুকুন বাচ্চা, চোখের পলকে লাফ দিয়ে তিন হাত ওপরে উঠে পড়ল ওটা, শূন্যেই ঘুরল, নিঃশব্দে নেমে এল আবার মাটিতে-আগের জায়গা থেকে অন্তত পাঁচ হাত দূরে, তারপর ছুটল। কান প্রায় লেপটে গেছে ঘাড়ের সঙ্গে, ছোট্ট লেজটা নাচছে ছোটার। তালে তালে, রাফিয়ানকে কলা দেখাল সে অবলীলায়। একটা ঝোঁপের ধারে গিয়ে ফিরে তাকাল পলকের জন্যে, মুখই ভেঙচাল বোধহয়, পরক্ষণে ঢুকে পড়ল ঝোপে।
রাফিয়ান কি আর ছাড়ে? ঝোঁপঝাড় ভেঙে হুড়মুড় করে পিছু নিল। সে-ও। ঝোঁপের ভেতরেই বোধহয় খরগোশের বাসা, গর্তের মুখ ছোট হয়তো, তাই খুঁড়তে শুরু করল কুকুরটা, ছিটকে আসা ধুলোমাটির ঝড় তা-ই প্রমাণ করছে। উত্তেজিত চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছে তার, গলা ফাটিয়ে ডাকছে জিনা, চলে আসতে বলছে, কানেই তুলছে না রাফিয়ান। পাগলের মত গর্তের চারপাশের মাটি খুঁড়ে মুখ বড় করছে, নিশ্চয়ই তার ভাষায় বাপ-মা তুলে গাল দিচ্ছে বজ্জাত বাচ্চাকে। বোধহয় বলছে, যাবে কোথায়! আসছি আমি! শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব!
রাফি! শুনছিস! এই, রাফি! চেঁচাল আবার জিনা। কতবার না বলেছি, খরগোশ তাড়া করবি না এখানে! শুনছিস! এই, পাজি!
রোখ চেপে গেছে রাফিয়ানের, মনিবের ডাকের তোয়াক্কাই করছে না। সে তার কাজে ব্যস্ত। কয়েকটা চড়থাপ্পড় লাগিয়ে, কান ধরে টেনে আনার জন্যে চলল জিনা। সে ঝোঁপটার কাছে এসে দাঁড়াতেই আচমকা থেমে গেল আঁচড়ের শব্দ, রাফিয়ানের ভয় মেশানো আর্তি শোনা গেল একবার, তারপরেই চুপচাপ। দুহাতে কাটাঝোঁপ সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিল জিনা।
রাফিয়ান গায়েব! ঘটনাটা কী! চমকে গেল জিনা। খরগোশের গর্ত দেখা যাচ্ছে, কালো ছড়ানো মুখ যেন বিশাল অজগরের হায়ের মত হয়ে রয়েছে। খুঁড়ে খুঁড়ে বড় করে ফেলেছে রাফিয়ান।
কিশোর! উদ্বিগ্ন হয়ে চেঁচিয়ে ডাকল জিনা। রাফিয়ান নেই! খরগোশের গর্তে পড়ে গেছে!
ঝোঁপের ধারে জিনার পাশে বসে কিশোরও উঁকি দিল ভিতরে। রবিন আর মুসাও এসে হাঁটু গেড়ে বসল গা ঘেঁষে।
গর্তে পড়ল! বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর। এত্তোবড় একটা কুকুর খরগোশের গর্তে পড়ে কী করে!
যেভাবেই হোক, পড়েছে! কেঁদে ফেলবে যেন জিনা। খুঁড়ে বের করা দরকার ওকে! জলদি না করলে দম আটকে মরে যাবে!
বেশ বড় ঝোঁপ, কাঁটা-ডাল, ভেতরে ঢোকা মুশকিল। তবে ভরসা, সঙ্গে যন্ত্রপাতি রয়েছে। ছুটে গিয়ে কুড়াল নিয়ে এল কিশোর। কুপিয়ে কাটতে লাগল কাঁটা-ঝোঁপ। সে আর মুসা মিলে অল্পক্ষণেই ঝোঁপের অনেকখানি উড়িয়ে দিল। হাতের কনুই পর্যন্ত ছড়ে-কেটে গেছে, রক্ত বেরিয়ে এসেছে চামড়া কেটে, খেয়ালই করছে না।
গর্তটার পারে বসে ভেতরে ঝুঁকে তাকাল কিশোর। অন্ধকার। টর্চের আলো ফেলল। চেঁচিয়ে উঠল বিস্ময়ে। এই জন্যেই তো বলি, এতবড় একটা বাঘাকুকুর খরগোশের গর্তে ঢোকে কী করে! জিনা, এটাই কুয়া! কুয়ার পারে খরগোশের বাসার মুখ, খুঁড়ে খুঁড়ে দুটো এক করে ফেলেছে রাফিয়ান। খরগোশের গর্তে পড়েনি, পড়েছে কুয়ার ভেতরে।