এ মুসা আর কিশোর মিলে রাফিয়ানকে টেনে তুলল নৌকায়। দাঁতে চেপে ধরেছে কাগজটা রাফিয়ান, কিন্তু এত আলতো করে, সামান্যতম দাগও পড়েনি দাঁতের! উদ্বিগ্ন হয়ে ভাজ খুলল কিশোর, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, বাঁচা গেছে! পানিতে ভিজেছে বটে, কিন্তু লেখার কোন ক্ষতি হয়নি। বল পয়েন্ট কলমের কালি, নষ্ট হয়নি। পাটাতনে কাগজটা। বিছিয়ে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে রাখল, যাতে আবার বাতাস উড়িয়ে নিতে না পারে। একবারেই শিক্ষা হয়ে গেছে।
বড় বাঁচা বেঁচেছি! বলল কিশোর।
অন্যেরাও স্বীকার করল কথাটা।
নৌকার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে আবার জিনা। দ্বীপের দিকে চলেছে।
বার বার গা ঝাড়া দিয়ে রোম থেকে পানি ঝরিয়ে নিয়েছে রাফিয়ান, রোদে পিঠ শুকাচ্ছে। পুরস্কার হিসেবে বড় একটা বিস্কুট পেয়েছে, কুটুর কুটুর করে কামড়াচ্ছে, চিবাচ্ছে আয়েশ করে। চোখা ডুবো পাথরের ফাঁকফোকর দিয়ে দক্ষ হাতে নৌকা বেয়ে চলেছে জিনা। মনে মনে তার প্রশংসা না করে পারছে না কিশোর, ঘোড়ায় চড়তে যেমন ওস্তাদ মেয়েটা, নৌকা বাওয়ায়ও তেমনি।
নিরাপদেই সরু প্রণালীতে ঢুকল নৌকা, ছোট্ট বন্দরে এসে ঘঁাচ করে থামল। লাফিয়ে বালিতে নামল অভিযাত্রীরা। টেনে নৌকাটা ডাঙার অনেক ওপরে তুলে রাখল, জোয়ারের পানি আর নাগাল পাবে না। মালপত্র নামাতে শুরু করল।
দুর্গের ঘরটায় নিয়ে যাব সব, কিশোর বলল। ওখানেই নিরাপদ। ঝড়বৃষ্টিতে নষ্ট হবে না; তবে, অন্য কেউ এসে পড়লে কী ঘটবে জানি না।
দুএক দিনের মধ্যে আসবে না মনে হয়, জিনা গাল চুলকাল। বাবা বলল, দলিলপত্র তৈরি করে রেজিস্ট্রি করাতে করাতে হপ্তাখানেক লেগে যাবে। হয়তো তার আগে আসবেই না ব্যাটা। এই
তার মানে, পাহারার দরকার নেই, প্রণালী দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের ওপর চোখ রাখার প্রয়োজন আছে কিনা ভাবছে কিশোর। চলো, যাই। মুসা, তুমি পানির ড্রাম নাও। খাবারের বোঝা আমি নিচ্ছি, খোন্তাগুলো নিক জিনা। রবিন, অন্য পোটলা-পাটলিগুলো তুমি নাও।
খাবার আর পানি প্রচুর পরিমাণে আনা হয়েছে; রুটি, মাখন, বিস্কুট, জ্যাম, টিনজাত ফল, শুকনো আঙুর, চায়ের সরঞ্জাম আর কয়েক বোতল লেমোনেড। সবচেয়ে ভারি দুটো বোঝা নিয়েছে কিশোর আর মুসা, টিলা বেয়ে উঠতে কষ্টই হচ্ছে ওদের, পা টলোমলো করছে, পিছলে পড়ে গেলে দোষ দেয়া যাবে না।
দুর্গের ছোট ঘরটাতে এনে মালপত্র তুলল ওরা। আবার ফিরে চলল কম্বল আর চাদরের বাণ্ডিল আনতে। আনা হয়ে গেল। মালপত্র গুছিয়ে রেখে ঘরের বাইরের চত্বরে এসে বসল ওরা।
এইবার আসল কাজ, ম্যাপটা মাটিতে বিছাল কিশোর। ডানজনে ঢোকার পর খুঁজে বের করতে হবে। জিনা, দেখো তো, কিছু বোঝে কিনা?
চারজনেই ঝুঁকে এল ম্যাপের ওপর। শুকিয়ে গেছে কাগজ, লেখা ঠিকই রয়েছে। নকশা দেখেই বোঝা যায়, পুরানো দিনে যখন আস্ত ছিল। দুৰ্গটা, দেখার মত বিল্ডিং ছিল!
এই যে দেখো, ডানজনের ওপর আঙুল রাখল কিশোর। মস্ত বড় পাতালঘর, আর এই এখানে…এখানে চিহ্ন বোধহয় সিঁড়ির নিশানা।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল জিনা, আমারও তাই মনে হয়। তার মানে, ডানজনে নামার দুটো পথ। একটা সিঁড়ি নেমেছে ওই ছোট ঘরটারই কোনখান থেকে…আরেকটা…আরেকটা টাওয়ারের নিচ থেকে, ওই যে ওই টাওয়ারটা, হাত তুলে কাক-টাওয়ার দেখাল সে। এটা কী, কিশোর?
একটা গোল চিহ্নের ওপর আঙুল রেখেছে জিনা, গোল একটা পাইপের মুখ যেন, পাইপটা ওপর থেকে শুরু হয়ে ডানজনের মেঝে ভেদ করে আরও নিচে নেমে গেছে।
কী জানি! নিচের ঠোঁটে বার দুই চিমটি কাটল কিশোর। ও, হ্যাঁ, বুঝেছি, কুয়ার কথা বলেছিলে না? এটাই সেটা। খুব গভীর। ওটাতে নামতে কেমন লাগবে ভেবে দেখো!।
কেমন আর লাগবে! বিড়বিড় করল মুসা। আমার রোম খাড়া হয়ে। গেছে এখুনি! কুয়া দিয়ে পাতালে নামা…আরিব্বাপ রে বাপ, আমি, বাবা, নেই ওতে!
মুসার বলার ধরনে হেসে ফেলল অন্যেরা, রাফিয়ানও কুকুরে-হাসি হাসল, বলল, হুফ! যেন বোঝাল, এত ভয় কীসের? আমি আছি না সঙ্গে?
এখন তা হলে কী করব? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল রবিন। সিঁড়ি খুঁজব? এই ঘরে থেকে থাকলে, এটা দিয়ে নামাই ভাল। যতদূর জানি, ওসব সিঁড়ির মুখ বড় চ্যাপ্টা পাথর দিয়ে ঢাকা থাকে। খুঁজব?
হ্যাঁ, ম্যাপটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে উঠে দাঁড়াল কিশোর।
শেওলা আর আগাছায় ঢেকে রয়েছে পাথুরে মেঝে, সিঁড়ির মুখ কোথায় বোঝার উপায় নেই।
পরিষ্কার করতে হবে, এগিয়ে গিয়ে একটা খোন্তা তুলে নিল কিশোর। তোমরাও নাও। কাজ শুরু করে দিই।
চারটে খোন্তা আনা হয়েছে। কাজে লেগে গেল ওরা। চেছে সাফ করে ফেলতে লাগল মেঝের আগাছা।
চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত ছেলেদের কাজ দেখল রাফিয়ান, ও আর বসে। থাকে কী করে? খোন্তা ধরতে পারবে না, তাতেই বা কী? চার পায়ে
পাঁচটা করে ক্ষুরধার নখ রয়েছে, বিশটা যন্ত্র নিয়ে সে-ও লেগে গেল। কাজে। আঁচড়ে-খামচে কাজ করতে গিয়ে অকাজই করল বেশি। ধুলো মাটি আর আগাছার টুকরোর ঝড় উঠল। তার সবচেয়ে কাছে রয়েছে। কিশোর, তার গায়েই ময়লা পড়ছে বেশি।
এহহে, রাফি, থাম, থাম। ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল কিশোর। বালু দিয়ে চুলের সর্বনাশ করে দিচ্ছিস আমার!
বারো
দেখতে দেখতে সাফ হয়ে গেল মেঝে। চারকোনা বড় বড় পাথর জোড়া দিয়ে তৈরি মেঝে, একটার সঙ্গে আরেকটার সামান্যতম তফাৎ নেই। কোনটা আলগা বোঝাই যাচ্ছে না। টর্চের আলো ফেলে সাবধানে প্রতিটি পাথর পরীক্ষা করে দেখল কিশোর, কিন্তু পাওয়া গেল না ফাঁক।