কী সুযোগ? উঠে বসল জিনা, বুঝতে পারছে না।
চাওয়ার, মিটিমিটি হাসছে কিশোর। তার ভাবভঙ্গিতে মুসা আর রবিনও অবাক হয়ে গেছে।
কী চাইব? দ্বীপ ছাড়া আর কী চাইব!
আর কিছু নেই?
না।
সত্যিই নেই? ভাল করে ভেবে দেখো…
মেঘের কোলে রোদ উঠল, হাসি ফুটল জিনার মুখে। আস্তে মাথা দোলাল, হ্যাঁ, আছে!
এগারো
পরদিন সকাল সকালই রওনা দেবে, ঠিক করল ওরা। কাগজ-পেন্সিল নিয়ে লিস্ট করতে বসল, কী কী সঙ্গে নেয়া দরকার।
খাবার লাগবে, প্রথমেই বলল মুসা। বেশি করেই নেব, যাতে টান না পড়ে।
পানি নিতে হবে, জিনা বলল। খাবার পানি নেই দ্বীপে। কুয়া একটা আছে শুনেছি, তাতে মিষ্টি পানি থাকার কথা, কিন্তু আমি খুঁজে পাইনি।
খাবার, লিখতে লিখতে বলল কিশোর। পনি। আর? তিনজনের দিকেই তাকাল সে। বিড়বিড় করল, খোন্তা, লিখে ফেলল সেটা।
কী হবে? মুসা অবাক।
মাটি খুঁড়ে ডানজনে নামার দরকার পড়তে পারে, কিশোর বলল। আর কী?
দড়ি লেখো, রবিন বলল।
আর টর্চ, জিনা মনে করিয়ে দিল। ভয়ানক অন্ধকার পাতালে।
আতঙ্কের দুর্গের ডানজনের কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠল মুসা। মনে পড়ল, কীভাবে হাত-পা বেধে পাতালঘরে ফেলে রাখা হয়েছিল ওদেরকে। ওরকম একটা ঘরে আরেকবার আটকা পড়তে চায় না সে কিছুতেই।
কম্বল, রবিন বলল। রাতে ঠাণ্ডা পড়বে, যা বাতাস লাগে দুর্গের ঘরটায়!
লিখে নিল কিশোর।
মগ লেখো, মুসা বলল। চা আর পানি খেতে লাগবে। আর কিছু যন্ত্রপাতি, এই…প্লায়ার্স, ক্রু-ড্রাইভার, এসব। কাজে লেগে যেতে পারে।
আধ ঘণ্টা পর লম্বা এক ফর্দ হয়ে গেল; যা যা মনে পড়েছে চারজনের, সব লিখে নেয়া হয়েছে। রাগ, ক্ষোভ, হতাশা অনেক কেটে গেছে জিনার
একা থাকলে, এত সহজে পারত না, তিন গোয়েন্দা সঙ্গ দেয়াতেই নিজেকে সামলাতে পেরেছে এত তাড়াতাড়ি। আর একা থাকব না, ভাবল জিনা। একা একা কোন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব না। একটা মাথার চেয়ে কয়েক মাথা একসঙ্গে খাটালে অনেক জটিল ব্যাপারও সহজ করে নেয়া যায়। আচ্ছা, এই ছেলে তিনটে এত শান্ত থাকে কী করে? কোন কারণেই হুট করে উত্তেজিত হয়ে যায় না। আমি হই কেন? কেন শান্ত রাখতে পারি না নিজেকে? আমার বদমেজাজের জন্যেই বাবা দেখতে পারে না আমাকে, বুঝতে পারছি এখন। মা-টা অতিরিক্ত ভাল, তাই আমার সব অত্যাচার সহ্য করে। নাহ, আর খারাপ থাকব না, ভাল হয়ে যাব। তিন গোয়েন্দা দারুণ শিক্ষা দিয়েছে আমাকে! বিশেষ করে ওই কিশোর পাশা…
জিনার দিকে নজর পড়তেই লক্ষ করল কিশোর, তামাটে চোখ দুটো তার মুখের ওপর স্থির। হাসল সে। কী ব্যাপার?
লজ্জা পেল জিনা, মুখ লাল হয়ে গেল। না, কিছু না! …ভাবছি, তোমরা কত ভাল, কত সহজ! দুদিনেই আমার বাবা-মাকে আপন করে নিয়েছ, ওদের সন্তান হয়েও এত বছরে আমি যা পারিনি! ইস, যদি তোমাদের মত হতে পারতাম!
দোষটা তোমার না, জিনা, কিশোর বলল। ধনী বাপের একমাত্র মেয়েরা সাধারণত ওরকমই হয়। এর অনেক কারণ।
তোমরাও তো তোমাদের বাপের একমাত্র ছেলে…
তা বটে, তবে ওরা ধনী নয়, অন্তত তোমার বাবার তুলনায় তো নয়ই। তা ছাড়া, আমার বাবা-মা ছোটবেলায়ই মারা গেছে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে, আদর দিয়ে দিয়ে মাথা খাওয়ার কেউ নেই। চাচা কম আদর করে না, মেরি চাচীও জান দিয়ে দেয় আমার জন্যে, নিজের মা থাকলেও এর বেশি করতে পারত না; তবে চাচীর সবচেয়ে বড় গুণ, শাসনটা ঠিকই আছে। বখে যেতে দেয়নি আমাকে। মুসার মা-ও যথেষ্ট কড়া। আর আমাদের রবিন মিয়া এমনিতেই ভাল,
দূর, কী যে বলো! বাবাকে তো রাগতে দেখোনি! ভালর ভাল, কিন্তু শাসনের সময়…।
হুঁ! নরম গলায় বলল জিনা। দেখো, আর কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না আমি! উঠল সে। চলো, খানিক বেড়িয়ে আসি। রাফিকে দেখে আসি।
ফগ আর রাফির সঙ্গে সারাটা দিন কাটাল ওরা। দ্বীপে গিয়ে কীভাবে কী করবে, তার নানারকম প্ল্যান করল। ওদের কথা যেন বুঝতে পারে। রাফিয়ান, এমনি ভঙ্গিতে মুখ গম্ভীর করে পাশে বসে থাকে আলোচনার সময়, মাঝে মাঝে সমঝদারের মত লেজ নাড়ে, বড় বড় বাদামী চোখ দুটোতে ফুটে ওঠে কেমন একটা ভাব! জ্বলজ্বল করে। বুদ্ধিমান মানুষের চোখের তারায় যেমন আলো দেখা যায়, তেমনি এক ধরনের আলো ফোটে!
পরদিন সকালে জিনিসপত্র নিয়ে নৌকা-ঘাটে চলে এল ওরা। নৌকা তৈরি রেখেছে ফগ। সবাই উঠে পড়ল। রাফিয়ানও উঠল। মালপত্র তুলে পাটাতনের একধারে রেখে দিল ফগ, তারপর ঠেলে নামিয়ে দিল নৌকাটা পানিতে। দাঁড় তুলে নিল জিনা।
সব কিছুই আনা হয়েছে, না? প্যাকেটগুলোর দিকে চেয়ে বলল কিশোর।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল জিনা।
ম্যাপ! ম্যাপটা এনেছ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
এনেছি, পকেটে হাত ঢোকাল কিশোর, বের করে আনল ভাজ করা কাগজটা দুআঙুলে ধরে। এই যে…
হঠাৎ এক ঝটকায় তার হাত থেকে কাগজটা উড়িয়ে নিয়ে পানিতে ফেলল জোরাল বাতাস। ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে লাগল, ওটা। শঙ্কিত হয়ে প্রায় একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল চারজনে। তাদের মহামূল্যবান নকশা!
ঝপাং করে গলুইয়ের আরেক পাশে দাঁড় ফেলে নৌকা ঘোরাতে শুরু করল জিনা। কিন্তু তার আগেই লাফিয়ে উঠল রাফিয়ান, কোন রকম দ্বিধা না করে ঝাঁপ দিল পানিতে। অত্যন্ত ভাল সাঁতারু সে। শক্তিশালী মাংসপেশীতে কাঁপন তুলে সাতরে গিয়ে কাগজটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল।