না, খালা, হাসিমুখে বলল কিশোর, ওসব চাইতে আসিনি। আমরা গোবেল দ্বীপে যেতে চাই।
যেতে চাইলে যাবে, এটা আর এমন কী হলো?
দুএক রাত কাটাতে চাই ওখানে।
রাত কাটাবি?
কেন, কী হবে, খালা? আকাশ পরিষ্কার, চেনা জায়গা, তেমন ভয়ের কিছু নেই তো। আর অবস্থা খারাপ দেখলে তো চলেই আসতে পারব, কয় মিনিট আর লাগে যেতে-আসতে।
হুঁ, তা বটে। জন, তুমি কী বলো? স্বামীর দিকে তাকালেন মিসেস পারকার।
যেতে চাইলে যাক, বললেন মিস্টার পারকার। নইলে আর যাওয়ার সুযোগ পাবে না। পাবে, ইয়ে, মানে, আমি বলছি কী, যেতে পারবে, তবে এখনকার মত নির্জন আর থাকবে না তখন। পিকনিক চলবে না ওখানে। লোকটা খানিক আগে আবার ফোন করেছিল। দ্বীপটা কিনতে চায়, ভাঙা দুর্গ সারিয়ে-সুরিয়ে নিয়ে একটা হোটেল করবে নাকি, ভাল আইডিয়া, না?
হাঁ হয়ে গেছে চার ছেলেমেয়ে, নাকেমুখে কষে থাবড়া মেরেছে যেন তাদেরকে কেউ। দ্বীপ বিক্রি! গোপন ব্যাপারটা ফাস হয়ে গেছে? জেনে ফেলেছে লোকটা? বুঝে গেছে, কোথায় লুকানো রয়েছে বারগুলো?
দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন জিনার, চোখে আগুন। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, মা-আ! তোমরা আমার দ্বীপ বেচতে পারো না! ওটা আমার দ্বীপ, আমার দুর্গ…তোমাদের কোন অধিকার নেই!
কুটি করলেন মিস্টার পারকার। বোকার মত কথা বলছ, জরজিনা! শঙ্কিত হয়ে উঠল কিশোর, মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে না তো বিজ্ঞানীর! ওটা এখনও তোমার হয়নি, তোমার মায়েরই রয়েছে। তোমার মায়ের থাকা মানেই আমার থাকা।
বাবা, টাকা কম আছে তোমার? কেঁদে ফেলল আবার জিনা। যা আছে তারই হিসেব রাখো না! ওই দ্বীপটা বেচলে আর কতই বা আসবে? কী করবে তুমি ওই টাকা দিয়ে? বলো, কী করবে?
ইয়ে..ইয়ে…হ্যাঁ, মানে…ও, হ্যাঁ, তোমার জন্যেই বিক্রি করছি। টাকাটা তোমার নামে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেব। যখন খুশি টাকা তুলে তোমার যা খুশি কিনতে পারবে। কত ভাল ভাল জিনিস।
ভাল জিনিস আমি চাই না! আবার চেঁচিয়ে উঠল জিনা। মা! দোহাই তোমাদের, ওটা বিক্রি করো না! তুমি, তুমি কথা দিয়েছিলে, ওটা আমাকে দেবে। দাওনি?
দি-দিয়েছিলাম! দ্বিধায় পড়ে গেছেন মহিলা। কিন্তু… স্বামীর দিকে তাকালেন তিনি, মেঘ জমতে আরম্ভ করেছে মিস্টার পারকারের মুখে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে, মা। তোর বাবা নিশ্চয় কথা দিয়ে ফেলেছেন, তাই…।
হ্যাঁ হ্যাঁ, কথা দিয়ে ফেলেছি, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন মিস্টার দরকার।
আমাকে একবার বলারও দরকার মনে করলে না, বাবা? আমি, তোমার সন্তান নই, বললো, জবাব দাও, নই? আমাকে ছেলেমানুষ ভাবো, কিন্তু আমারও তো একটা মন আছে…
সাংঘাতিক দ্বিধায় পড়ে গেছেন মিস্টার পারকার; ওদিকে ক্রেতাকে কথা দিয়ে ফেলেছেন, এদিকে মেয়ের এই অভিমান, কী করবেন? কিছুই ঠিক করতে না পেরে আচমকা রেগে উঠলেন তিনি, চেঁচিয়ে উঠলেন, তোর খারাপ চেয়েছি নাকি আমি? বললাম, সব টাকা দিয়ে দেব, যা খুশি কর গে…
তোমার টাকা তুমিই রাখো গে, যাও! মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল জিনা। একটা পয়সাও আমি ছোঁব না! ছোঁব না! এক ছুটে বেরিয়ে চলে গেল সে, দুপদাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল, বোঝা গেল আওয়াজ শুনেই।
হতভম্ব হয়ে গেলেন মিস্টার পারকার। তিন গোয়েন্দাকে বললেন, ওকে গিয়ে বোঝাও তোমরা। তোমাদের বন্ধু, হয়তো শুনবে। আসলে, এখন আর কিছু করতে পারছি না, আমার মান-ইজ্জতের প্রশ্ন! কথা দিয়ে ফেলেছি লোকটাকে!
দলিল কবে হচ্ছে, খালু? শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল কিশোর।
এ হপ্তার ভেতরেই। কালই চলে যাও, গিয়ে পিকনিক করে এসো। পরে নতুন মালিক আর দ্বীপে উঠতে দেবে কিনা দেবে, কে জানে!
কার কাছে বিক্রি করছেন? বাক্সটা যাকে দিয়েছেন?
হ্যাঁ, লজ্জিতই মনে হচ্ছে তাকে। প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! আর ব্যাটা একটা চিনেৰ্জোক, এমনভাবে ধরল, বোঝাল, হ্যাঁ বলে ফেললাম! …যা হওয়ার হয়ে গেছে, জরজিকে গিয়ে বলো, ওরকম, না না, ওটার চেয়ে ভাল আরেকটা দ্বীপ ওকে কিনে দেব! যা চায়, তাই দেব, যাও বলো গে!
কথা দিচ্ছেন? রহস্যময় হাসি ফুটেছে কিশোরের মুখে।
হ্যাঁ, দিচ্ছি!
বেশ, আমিও কথা দিচ্ছি, জিনাকে শান্ত করব। মুসা আর রবিনকে নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। বাইরে বেরিয়েই বলল, কিছু বুঝলে, লোকটা দ্বীপ কেন কিনতে চাইছে?
ম্যাপের মানে বুঝে ফেলেছে, আরকী? রবিন বলল।
হোটেল না কচু! মুসা বলল। শয়তানটা আসল কথা জেনে ফেলেছে, পটিয়ে-পাটিয়ে এখন দ্বীপ বিক্রিতে রাজি করিয়ে ফেলেছে জিনার বাবাকে। হারামখোর!
বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদছে জিনা। তার কাছে গিয়ে বসল কিশোর। কোমল গলায় ডাকল, জিনা!
জবাব দিল না জিনা, মুখ তুলল না।
জিনা, শোনো, কিশোর বলল আবার, এত নিরাশ হয়ো না, যা হয়েছে ভালই হয়েছে!
ভাল হয়েছে! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। আমার এত সাধের দ্বীপ ওরা কেড়ে নিচ্ছে, আর তুমি বলছ ভাল হয়েছে?
ভালই তো হয়েছে, হাসল কিশোর। কাল যাচ্ছি আমরা গোবেল দ্বীপে। থাকব। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করব সোনার বারগুলো। লোকটা আসার আগেই কাজ সেরে ফেলব আমরা।
মুখ ফেরাল জিনা। কিন্তু আমার দ্বীপ…।
ওটার জন্যে দুঃখ কোরো না। তোমার বাবা বলেছেন, তোমাকে আরও ভাল দেখে আরেকটা দ্বীপ কিনে দেবেন। যা চাও, তাই দেবেন। আমি হলে এই সুযোগ কিছুতেই ছাড়তাম না।