কে? চিবাতে চিবাতে বললেন জিনার বাবা।
খবরের কাগজের লোক। দেখা করতে চায়। জরুরি কথা আছে বলল।
এখন হবে না, হাত নাড়লেন মিস্টার পারকার। বলে দাও, ছটার। সময় আসতে।
আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল ছেলেরা। যা আপনভোলা মানুষ মিস্টার পারকার, বাক্সটা আর ভিতরের জিনিসপত্র দেখিয়ে দেবেন না তো রিপোর্টারদের? দুর্গের পাতাল ঘরে সোনার বার লুকানো রয়েছে, কোনমতে গুজবটা একবার রটে গেলে, সর্বনাশ!
ইস, গাধামি হয়ে গেছে! ভাবল কিশোর। ম্যাপটা বাক্সে রাখা মোটেই উচিত হয়নি!
দশ
পরদিন সকালে স্থানীয় সমস্ত কাগজে প্রকাশিত হলো খবরটা: কী করে ঝড়ের ধাক্কায় সাগরের তল থেকে উঠে পাথরে আটকে গেছে শত শত বছরের পুরানো জাহাজ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে সব কথাই মিস্টার পারকারের পেট থেকে বের করে নিয়েছে ধড়িবাজ সাংবাদিক, নিখোঁজ সোনার বারের গল্পও জেনে গেছে, তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে চলে গেছে গোবেল দ্বীপে, কীভাবে জানি পথ খুঁজে নিয়ে ওপরে উঠে গিয়ে কয়েকটা ছবিও তুলে এনেছে ভাঙা দুগটার, আর জাহাজের ছবি তো আছেই, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আকর্ষণীয় সব ছবি তুলে দিয়েছে কাগজে ছেপে।
রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করল জিনা। দুপদাপ করে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। মা-আ! এসব কী! ওটা আমার দ্বীপ! তুমি কথা দিয়েছিলে, দাওনি!
তোর নয় একথা তো বলিনি! ভুরু কোঁচকালেন মা। ওরা দ্বীপে গিয়ে ছবি তুলেছে তো কী হয়েছে? নষ্ট তো আর করে ফেলেনি।
কিন্তু গেল কেন? কার কাছে অনুমতি নিয়ে? আরও রেগে উঠল জিনা! ওগুলো আমার! দ্বীপ, দুর্গ, জাহাজ…আমাকে না বলে ওরা যায় কী করে?
খামোকা রাগ করছিস, মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন মা। তোর বাবা অনুমতি না দিলেই বা কী হত? সাগরের মালিক তো আর আমরা না, বোট নিয়ে গিয়ে জাহাজের ছবি তুলতই ওরা। দুর্গের ছবিও। মানা করলেও ঠেকানো যেত না।
এরপর দর্শকদের ঠেকানোর চেষ্টা করল জিনা, পারল না, কেয়ারই করল না কেউ তার কথা, রাগে-দুঃখে চোখে পানি এসে গেল তার। পুরানো একটা জাহাজ পানিতে ভেসে উঠে যে এমন শোরগোল তুলবে, এতটা শোরগোল, কল্পনাও করতে পারেনি ছেলেরা, তাজ্জব হয়ে লোকের কাণ্ড দেখল ওরা। অনেক দূর থেকেও খবর শুনে জাহাজ দেখতে এল লোকে, দ্বীপ আর দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখল। এত দিন চেষ্টা করেনি তাই, এখন দরকারের সময় ছোট্ট লুকানো বন্দরটা ঠিকই খুঁজে বের করে। ফেলল জেলেরা। মাছ ধরা বাদ দিয়ে ট্যুরিস্ট আনা-নেয়া করতে লাগল। নৌকায় করে, যার যা খুশি ভাড়া হাঁকছে, কামিয়ে নিচ্ছে দুপয়সা।
গুমরে মরছে জিনা, তাকে শান্ত করার চেষ্টা চালাল কিশোর। শোনো, জিনা, বারগুলোর কথা এখনও জানে না কেউ। উত্তেজনা কমে এলেই দ্বীপে গিয়ে ওগুলো খুঁজে বের করব।
আমাদের আগেই যদি অন্য কেউ পেয়ে যায়? চোখ মুছতে মুছতে বলল জিনা, কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
কী করে? বাক্সের ভেতরের নকশা এখনও কারও চোখে পড়েনি। দাঁড়াও না, আরেক সুযোগে আবার চুরি করে নিয়ে আসব নকশাটা, আর ফেরত দেব না।
কিন্তু সে সুযোগ আর পেল না কিশোর। ইতিমধ্যেই অঘটন ঘটিয়ে ফেললেন মিস্টার পারকার। পরের দিন ডাইনিং রুমে খাচ্ছিল ছেলেরা, হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন তিনি। ঘোষণা করলেন, এক পাগলা অ্যান্টিক সংগ্রহকারীকে উপহার দিয়ে দিয়েছেন বাক্সটা। না, ভিতরে কী আছে না। আছে খুলেও দেখেননি তিনি।
আতঙ্কিত হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল ছেলেরা। সর্বনাশ হয়ে গেছে! যদি ওই লোকটা নকশার মানে বুঝতে পারে? হয় সে গোপনে বারগুলো খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করবে, কিংবা বোকা হলে লোকের কাছে বলবে। পরের দিনই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় খবর হয়ে বেরোবে কথাটা, ব্যস, তারপর আর কী!
মেজাজ খুব ভাল এই মুহূর্তে জিনার বাবার, আশ্চর্য একটা ব্যাপার! কেন ভাল, কে জানে! লোকটা তোয়াজ করে ফুলিয়ে-টুলিয়ে দিয়ে গেছে। হয়তো। তবে এই মেজাজ কতক্ষণ থাকবে, ঠিক নেই; যে-কোন মুহূর্তে মেঘের আড়ালে চলে যেতে পারে রোদ, আচমকা ঝড় উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। একবার ভাবল কিশোর, তাকে সব কথা খুলে বলে, কিন্তু ভেবে চিন্তে শেষে না বলারই সিদ্ধান্ত নিল। হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবেন, সেক্ষেত্রে না বলাই ভাল, অযথা হাসির খোরাক হয়ে কী লাভ?
নিজেদের মাঝে আলোচনা করল ছেলেরা। ঘোরালো হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। জিনার মাকে বারগুলোর কথা বলবে কিনা, ভাবল ওরা, তারপর সে চিন্তাও বাতিল করে দিল। তিনিও বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না।
ওসব বলাবলির দরকার নেই, অবশেষে বলল কিশোর। যা বলছি শোনো। খালাকে গিয়ে ধরব আমরা, গোবেল দ্বীপে পিকনিকে যেতে চাই। দুটো রাত থাকবও ওখানে। যে করেই হোক তাকে রাজি করাতে হবে। এতে সময় পাব আমরা। আগামী দুদিনের আগে কেউ গুপ্তধন খুঁজতে আসবে না আশা করছি, তৈরি হওয়ার একটা ব্যাপার আছে তো।
কিশোরের প্রস্তাব মেনে নিল সবাই। পরের দিনই সকালে রওনা দেবে, ঠিক করল ওরা। আবহাওয়া এখন পরিষ্কার, সঙ্গে করে প্রচুর খাবার নিয়ে যাবে, অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। জিনার মাকে গিয়ে ধরল। ওরা। তখন মিস্টার পারকারও রয়েছেন ওখানে। মেজাজ ভালই।
খালা, কিশোর বলল, একটা কথা বলব। রাখবেন?
কী রে? অবাক হলেন মিসেস পারকার। এমনভাবে বলছ, যেন রাজ্য আর রাজকন্যা চেয়ে বসবে?