গান থামল এক সময়।
কিশোর, মুসা বলল, খাচ্ছি কখন? পেট জ্বলছে খিদেয়।
এখনি? জানালার দিক থেকে মুখ ফেরাল কিশোর। মাত্র তো এগারোটা। আরও ঘণ্টা দেড়েক যাক।
খাইছে, এতক্ষণ! আঁতকে উঠল মুসা। টিকব না! সেই ভোরে কখন কী খেয়েছি ভুলেই গেছি!
হেসে ফেলল কিশোর। ব্যাগ খুলে বড় তিনটে চকলেট বের করে একটা করে তুলে দিল রবিন, আর মুসার হাতে। নিজেরটারও মোড়ক ছাড়িয়ে কামড় বসাল। আবার চোখ ফেরাল বাইরে। দুপাশে তৃণভূমি, তার ওপারে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল। পথের ধারে বড় বড় গাছ, স্যাৎ স্যাৎ করে সরে যাচ্ছে।
বারোটা নাগাদ একটা স্টেশনে থামল বাস। এখানে গাড়ি বদল করতে হবে, বাস থেকে নামল তিন গোয়েন্দা।
পাহাড়ের ধার ঘেঁষে এখানে চলে গেছে পথ। নিচে ছড়ানো উপত্যকা রোদে ঝলমল করছে। গরু-ভেড়া চরছে। খেয়ে নিয়ে তারপর বাসে উঠবে ঠিক করল তিন গোয়েন্দা। ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল ওরা, একটা বড় গাছ দেখেছে, তার ছায়ায় বসে খাবে।
পেছনে আচমকা ম-অঁ-অ্যাঁ! শুনে ইয়াল্লা! বলে চেঁচিয়ে এক লাফ মারল মুসা। ফিরে চেয়ে দেখল, বাদামী রঙের একটা গরু বড় বড় অবাক চোখ মেলে তাকে দেখছে। হো হো করে হেসে উঠল কিশোর আর রবিন।
সঙ্গে আনা স্যাণ্ডউইচ দিয়ে খাওয়া সারল ওরা।
কটার সময় পৌঁছুব? আঙুল চাটছে মুসা। খাওয়াটা জুতসই হলো না। শিগগিরই খিদে লেগে যাবে।
এই, সাতটা-আটটা তো বাজবেই, কিশোর জবাব দিল। হাত-পা ছড়িয়ে ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সে। আরেকটা লম্বা যাত্রা।
আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না? প্রস্তাব দিল রবিন। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিলেই তো পারি? ভিড়ও হবে না, যেতেও পারব তাড়াতাড়ি।
হুঁ, কথাটা মন্দ না, এক কনুইয়ে ভর রেখে কাত হয়ে শরীরটাকে সামান্য তলল কিশোর। তাই করব। মুসা, দেখো না একটা ট্যাক্সি।
আবার যাত্রা শুরু হলো। চোখের পলকে যেন এগিয়ে আসছে মাইল। পোস্টগুলো, পেছনে পড়ে যাচ্ছে। বিকেলের দিকে একটা বড় পাহাড়ে উঠতে শুরু করল গাড়ি, পথটা পাহাড় পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ করেই যেন চূড়ায় পৌঁছে গেল গাড়ি, সাগর চোখে পড়ল। বিকেলের সোনালী আলোয় সূরের সাগরটাকে দেখাচ্ছে মস্ত এক আয়নার মত।
ওই যে! এসে পড়েছি! হাত তুলল কিশোর।
দারুণ! চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে রবিন।
ইস, এখুনি গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে! মুসা বলল।
আর বড় জোর মিনিট বিশেক লাগবে, কিশোর বলল। খুব তাড়াতাড়িই এসেছি। বাসে এলে অর্ধেক পথ আসতাম এতক্ষণে।
সৈকতের ধার দিয়ে ছুটছে ট্যাক্সি।
খুবই সুন্দর! কিশোর বলল। কী ঘন নীল!
আর দ্বীপগুলো দেখেছ? রবিন অভিভূত। যেন ছবি! নাহ, এসে ভুল করিনি, কিশোর!
গোবেল ভিলাটা এখন খুঁজে পেলেই হয়! মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।
কিন্তু পাওয়া গেল গোবেল ভিলা, সহজেই। একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করতেই হাত তুলে দেখিয়ে দিল। ছোট একটা পাহাড়ের মাথায় বিশাল এক বাড়ি, সাগরের দিকে মুখ করা। শ্বেতপাথরে তৈরি, নিশ্চয় অনেক পুরানো আমলের। সামনে ছড়ানো বাগান, ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে, গোলাপই বেশি।
বাড়ির সিংহ-দরজার মস্ত খুঁটিও শ্বেতপাথরে তৈরি, ধনুকের মত বাকানো গেটের কপালে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে: গোবেল ভিলা। ধবধবে সাদা পাথরে যেন ফুটে রয়েছে কালো অক্ষরগুলো।
ব্যস, পৌঁছে গেলাম! চেপে রাখা শ্বাসটা শব্দ করে ছাড়ল গোয়েন্দাপ্রধান।
দুই
খোয়া বিছানো পথ ধরে গাড়ি-বারান্দায় এসে থামল ট্যাক্সি, শব্দ শুনেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন এক মহিলা। সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে দাঁড়ালেন গাড়ির পাশে। মেরি চাচীর বয়েসী, বেশ সুন্দরী, হাসিতে উজ্জ্বল মুখ। মহিলাকে ভাল লাগল ছেলেদের।
এসে পড়েছ! হেসে বললেন মহিলা। তোমাদের অপেক্ষায়ই ছিলাম। তাড়াতাড়িই এসেছ।
ট্যাক্সিতে এসেছি, তাই, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল কিশোর। দরজা খুলে নামল। রবিন আর মুসাও নামল। গালে চুমু খেয়ে ছেলেদেরকে স্বাগত জানালেন মহিলা। ট্যাক্সি। বিদায় করে দেয়া হলো। পথ দেখিয়ে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে এলেন ড্রইংরুমে। বিরাট হলরুম, আসবাবপত্র সব পুরানো আমলের, কিন্তু খুব। সুন্দর।
চারপাশে তাকিয়ে কিশোর বলল, কই, জর্জকে দেখছি না?
ওর কথা আর বোলো না, হাসলেন মহিলা। ও কি বাড়ি থাকে? তোমরা আসবে, আমাকে বলে সেই সকালে বেরিয়েছে, আর দেখা নেই। হয়তো মাছ ধরছে জেলে ছেলেদের সঙ্গে, কিংবা পাহাড়ে উঠে পাখির ডিম পাড়ছে। বড় বেশি দুষ্ট হয়েছে, কথাবার্তা এক্কেবারে শোনে না…
এক পাশে দরজা খুলে গেল। লম্বা একজন লোক ঘরে ঢুকলেন, ফেকাসে চামড়া রোদের মুখ দেখে বলে মনে হলো না, বাদামী মস্ত গোঁফ, চওড়া কপাল বিরক্তিতে কোঁচকানো, চোখ দুটো চেহারার সঙ্গে বেমানান-বড় বড়, তাতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ।
এই, শোনো, ভদ্রলোককে ডাকলেন মহিলা। ওরা রকি বিচ থেকে এসেছে, জর্জের বন্ধু। ছেলেদেরকে বললেন, ও জর্জের বাবা।
উঠে এগিয়ে এসে হাত বাড়াল কিশোর। আমি কিশোর পাশা:..ও মুসা আমান। আর ও হলো রবিন মিলফোর্ড।
হুঁ, তোমরা বসো, বিরক্তিতে আরও কুঁচকে গেল জর্জের বাবার চেহারা। হট্টগোল একদম পছন্দ করি না আমি, বুঝেছ? চুপচাপ, থাকবে। বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ওর কথায় কিছু মনে কোরো না, তাড়াতাড়ি বললেন মহিলা। ও এরকমই। তবে মনটা খুব ভাল। সারাদিন কী সব গবেষণা নিয়ে থাকে, এখন একটা বই লিখছে, বিজ্ঞানের কী একটা জটিল বিষয়ের ওপর। তাই অমন খিটখিটে মেজাজ।