এত শত বছর পানির তলায় পড়ে ছিল, অথচ এক ফোঁটা পানি ঢোকেনি, খটখটে শুকনো! হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা বের করে আনল সে। কাপড় খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একটা ডায়েরি! হু, তোমার নানার-নানার-বাবার হাতের লেখা, পড়া তো যাচ্ছে না।
এত গুঁড়ি গুঁড়ি, লেখা তো না, পিঁপড়ের সারি!
একটা পাতা দুআঙুলে ধরে পরখ করে দেখল জিনা। তুলট কাগজের মত কাগজ, বয়েসের ভারে হলদে হয়ে এসেছে। ডায়েরিটা নাড়াচাড়া করছে কিশোর, হঠাৎ ভিতর থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ পড়ল বালিতে। প্রায় ছোঁ মেরে ওটা তুলে নিল সে। মানচিত্র! নকশা! কাগজটা ডায়েরির পাতার চেয়েও হলুদ। তাড়াহুড়ো করতে গেলে যদি ভাজে ভাজে ছিঁড়ে খুলে চলে আসে, এই ভয়ে সতর্ক হয়ে আস্তে আস্তে খুলে বিছাল ওটা বালিতে।
হুঁ, ম্যাপই মনে হচ্ছে! আপনমনে বলল সে মাথা দুলিয়ে, কিন্তু আজব ম্যাপ! ঠিক বোঝা যাচ্ছে না!
জিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ম্যাপটার দিকে, রক্ত সরে যাচ্ছে তার মুখ থেকে। ঝট করে মুখ তুলল, চোখে জ্বলজ্বলে আলো। কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছে, কিন্তু বলতে পারছে না। তার ভাবভঙ্গিতে অবাক হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা।
কী? অবশেষে জিজ্ঞেস করল কিশোর। বোবা হয়ে গেছ? কী ব্যাপার?
জোরে জোরে মাথা ঝাঁকি দিল জিনা, ঝাঁকুনি খেয়েই যেন গলার সুড়ঙ্গে আটকে থাকা প্রতিবন্ধক ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল কথার স্রোত, কিশোর, জানো ওটা কি! জানো! জানো! ওটা ম্যাপ, একটা ম্যাপ! দুর্গের ম্যাপ, গোবেল দুর্গের, যখন ওটা আস্ত ছিল, ধসে পড়েনি! এই যে, এই যে দেখো, এক জায়গায় আঙুল রাখল। ডানজন! পাতালঘর! আর এই যে, ডানজনের কোনায় কী জানি লেখা!
লেখার ওপরে রাখা জিনার কাঁপা কাঁপা আঙুল সরিয়ে দিল কিশোর। সবারই চোখ এখন লেখাটার ওপর। পুরানো ধাচের পেচানো হরফে রয়েছে একটিমাত্র অদ্ভুত শব্দ: ইনগটস।
ইন-গটস! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ইয়াল্লা! এটা আবার কী জীব! কোন দৈত্য-টৈত্য, নাকি ভূতের সর্দার!
হেসে ফেলল রবিন, কিশোরও।
এই জন্যেই বলি, বই-টই একটু পড়ো, বলল রবিন। দুনিয়ার কিছুই তো জানো না।
হেই, মিয়া, মুখ সামলে কথা বলবে! রেগে উঠল মুসা। জানি না। মানে? কয় ধরনের খেলা আছে, খেলার সরঞ্জাম আছে, জানো তুমি? জানো, এবার রেসলিঙে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কে হয়েছে? কয় রকমের খাবার আছে দুনিয়ায়, জানো? জানো, ঠিকমত রাঁধতে জানলে শুয়োপোকার গন্ধও জিভে পানি ঝরিয়ে ছাড়ে…।
হুঁউক! ওয়াক থুহ! গলা চেপে ধরল জিনা, বমি ঠেকাচ্ছে। রাক্ষস কোথাকার!
বিমল হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুসার কুচকুচে কালো মুখে। তো, যা বলছিলাম, রবিন, সবাই সব কিছু জানে না। তুমি যা জানো, সব আমি জানি না, আবার আমি যা জানি, সব তুমি জানো না…
আরে, দূর, লেকচার রাখো! বিরক্ত হয়ে হাত তুলল কিশোর। ইনগটস মানে হলো ধাতুর বার। তবে এখানে সোনার কথাই বোঝানো হয়েছে, আমি শিওর।
খাইছে! আঁ, সোনা! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মুসার। জাহাজ থেকে যেগুলো গায়েব! দুৰ্গটার তলায় না তো? ডানজনে..
মাথা ঝোকাল জিনা। মনে হচ্ছে তাই! ইস, যদি খুঁজে বের করতে পারতাম! বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন ফিসফিস করল, ইস, যদি পারতাম!
পাই আর না পাই, খুঁজব। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিশোর। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার সামিল হবে কাজটা, তবু চেষ্টা না করে ছাড়ব না। কিন্তু ভাঙা দুর্গ, ঝোঁপঝাড়, জঙ্গল…যাক গে! আগে থেকে ভেবে লাভ নেই, উপায় একটা নিশ্চয় বেরোবে।
চিন্তিত চোখে বাক্সটার দিকে তাকাল কিশোর। এটা কী করব? নিজেকে প্রশ্ন করছে সে। আবার রেখে দিয়ে আসব? জেগে উঠে না। দেখলে নিশ্চয় খুঁজবেন, তার চেয়ে রেখেই দিয়ে আসি!
ম্যাপটা রেখে দিই আমরা। শুধু ডায়েরিটা বাক্সে ভরে রেখে দিয়ে এলেই তো হয়? মুসার প্রস্তাব।
তার চেয়ে আরেক কাজ করি বরং, রবিন বলল, সবই রেখে আসব। ম্যাপের একটা কপি করে রেখে দেব নিজেদের কাছে।
হ্যাঁ, কথাটা মন্দ না, কিশোর বলল। তবে ম্যাপ না ফিরিয়ে দিলেও তো চলে, উনি তো আর দেখেননি ভেতরে কী আছে না আছে। …আচ্ছা, থাক, রেখেই আসব; তার আগে, চলো, কপিটা করে নিই।
বাগানে ফিরে এল ওরা। চট করে গিয়ে নিজের ঘর থেকে বল পয়েন্ট আর কাগজ নিয়ে এল জিনা। দেখে দেখে ম্যাপটর নিখুঁত একটা নকল এঁকে ফেলল কিশোর। তারপর ডায়েরির ভিতরে আবার আসলটা ভরে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে দিল বাক্সে, হাত দিয়ে চেপে নামিয়ে দিল বাকানো টিন, যতটা সম্ভব সমান করে দিল আগের মত, যাতে বোঝা না যায় খোলা হয়েছিল। নকলটা সাবধানে ভাজ করে নিজের পকেটে রেখে দিয়ে বাক্স হাতে উঠে দাঁড়াল। রেখে আসি।
আবার এসে জানালায় উঁকি দিল কিশোর, আরেকটু হলেই জিনার বাবার চোখে চোখ পড়ে যেত, সঙ্গে সঙ্গে মাথা নুইয়ে ফেলল সে। কিন্তু ব্যাপার কী? এখনও হৈ-চৈ শুরু করেননি কেন? বাক্সটা নেই, খেয়ালই করেননি?
করেননি বোঝা গেল চায়ের টেবিলে। ছেলেদের দিকে তাকালেনই না, চুপচাপ খাচ্ছেন। সুযোগ বুঝে এক ফাঁকে গিয়ে বাক্সটা আবার জায়গা মত রেখে এল কিশোর, সঙ্গীদের দিকে চেয়ে চোখ টিপল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ছেলেরা।
টেলিফোন বাজল হঠাৎ। উঠে গিয়ে ধরলেন মিসেস পারকার। ওখানে দাঁড়িয়েই ডেকে বললেন, জন, তোমার।