সোনার বার! ভুরু কুঁচকে গেছে বিজ্ঞানীর। একেবারেই বুন্ধু! আরে, বোকা, এই বাক্সে বার থাকে কী করে! দেখছিস না, ছোট? জাহাজটায় সোনার বার ছিল, গপ্পোটা আমিও শুনেছি। হয়তো ছিল, কিন্তু এখন নেই। অনেক আগেই কেউ না কেউ কোথাও সরিয়ে ফেলেছে, জাহাজে নেই।
থাকলে থাকুক, না থাকলে নেই, চোখে পানি এসে গেছে জিনার, মরিয়া হয়ে বলল, আমার বাক্স দিয়ে দাও। ওটা তুমি নিচ্ছ কেন? কেন জানি তার এখন মনে হচ্ছে, ভেতরে সোনাদানা না থাকুক, মূল্যবান। দলিলপত্র নিশ্চয় রয়েছে, যাতে গুপ্তধনের নকশা আঁকা আছে।
কিন্তু বাক্সটা দিলেন না মিস্টার পারকার, হাতে নিয়ে নেমে চলে গেলেন।
আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি! লজ্জিত কণ্ঠে বলল মুসা। সব ফাঁস করে দিয়েছি!
যা হবার হয়েছে, মুসার কাঁধে হাত রাখল কিশোর। দুঃখ করে লাভ নেই।
বাক্সটা আবার পাই কী করে, ভাবছি! রবিন বলল।
হ্যাঁ, মাথা ঝোকাল কিশোর। পাই কী করে? জিনার দিকে তাকাল সে। কীভাবে?
বাবার ঘরের ওপর চোখ রাখতে হবে, ভেবে বলল জিনা। বেরোলেই চুরি করব। আর কোন উপায় দেখছি না।
ঠিকই, আর কোন উপায় নেই। কাজেই মিস্টার পারকারের কাজের ঘরের কাছে ঘুরঘুর করতে থাকল ওরা। সারাক্ষণই কেউ না কেউ চোখ রাখল দরজার দিকে।
কী কারণে বাইরে এলেন জিনার মা, ছেলেদেরকে বাগানে একই জায়গায় ঘুরঘুর করতে দেখে অবাক হলেন। আরে, অবাক কাণ্ড! তোরা সব এখানে? মুখ শুকনো কেন এমন? ঝগড়াঝাটি করেছিস নাকি?
না, খালা, তাড়াতাড়ি জবাব দিল মুসা, ঝগড়া করব কেন? এই এমনি…
হুঁ! ঠোঁট ওল্টালেন তিনি। কী জানি, বাপু! তোদের মতিগতি কিছু বুঝি না। নিজের কাজে চলে গেলেন তিনি।
কী ব্যাপার, জিনা? রবিন আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। তোমার বাবা কি ঘর থেকে বেরোবেন না? এভাবে ঘরে বসে থাকা এটা কোন কাজের কাজ হলো?
কাজের কাজ করে নাকি বিজ্ঞানীরা? সাফ বলে দিল জিনা। সব অকাজ! এই জন্যেই তো মেজাজ এমন তিরিক্ষি হয়ে থাকে ওদের! ঘরের কোথায় একটা ইটের কণা পড়ল, তার শব্দেই চমকে ওঠে বাবা! বাবার জালায় টু শব্দ করার জো আছে? হোস্টেলই আমার ভাল!
কিশোর তাদের কথায় যোগ দিল না। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে এল। কাজ করছেন। আর কোন কথা না বলে একটা গাছের ছায়ায় গিয়ে বই খুলে বসল।
ঘর থেকে একটিবারের জন্যে বেরোলেন না মিস্টার পারকার। দুপুর হয়ে এল। খাওয়ার জন্যে ডাকতে এলেন জিনার মা।
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গিয়ে খেয়ে আসতে হলো ছেলেমেয়েদের। ফিরে এসে আবার আগের জায়গায় বই খুলে বসল কিশোর। গাছের ছায়ায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল অন্য তিনজন।
বিকেল হয়ে এল। হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলল কিশোর। তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। জিনার গায়ে ঠেলা দিল, সে চোখ মেলতেই বলল, জিনা, কীসের শব্দ? তোমার বাবার ঘর থেকে আসছে!
কান পেতে শুনল জিনা। আর কীসের? বাবা নাক ডাকাচ্ছে।
এ-ই সুযোগ! বই রেখে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। দেখি চেষ্টা করে!
জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল কিশোর, বড় একটা আর্ম চেয়ারে আধশোয়া হয়ে নাক ডাকাচ্ছেন জিনার বাবা, মুখ খোলা, চোখ বন্ধ, ঘুমে অচেতন। মাথা বেকায়দাভাবে কাত হয়ে রয়েছে এক পাশে, ফলে, যতবারই শ্বাস টানছেন, বিকট শব্দ হচ্ছে।
নাহ, ঘুমিয়েছে! ভাবল কিশোর, বাক্সটার দিকে তাকাল, মিস্টার পারকারের ওপাশে টেবিলে রয়েছে। নিই ঝুঁকিটা! ধরা পড়লে চড়থাপ্পড়ও দিয়ে বসতে পারে, কিন্তু আর কোন উপায় নেই!
পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে পড়ল কিশোর। আর্ম চেয়ারের কাছে এসে থামল এক মুহূর্ত, মিস্টার পারকারের মুখের দিকে তাকাল, তারপর ঘুরে চলে এল টেবিলের কাছে। বাক্সটা তুলে নিল কাঁপা কাঁপা হাতে, দুরুদুরু করছে বুকের ভেতর, গলা শুকিয়ে কাঠ-ঘন ঘন ঢোক গিলতে হচ্ছে, তাড়াহুড়োয় বাক্সের ওপরে রাখা আলগা একটা কাঠের টুকরো পড়ে গেল মেঝেতে। ছোট্ট খুটুস শব্দ, কিন্তু কিশোরের মনে হলো বোম ফাটল। চোখের পলকে এসে লুকিয়ে পড়ল আর্ম চেয়ারের পেছনে।
কী হলো! বিড়বিড় করলেন মিস্টার পারকার, নাক ডাকানোয় ব্যাঘাত ঘটল, কয়েক মুহূর্তের জন্যে, তারপরই আবার শুরু হলো নিয়মিত, খোঁওঁওঁওঁ-খেত!
আর দেরি করল না কিশোর, বাক্সটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল নিঃশব্দে। বাইরে বেরিয়েই দে ছুট। সঙ্গীদের মুখের দিকে চেয়ে চাপা গলায় বলল, সোজা সৈকতে! ছুটতে শুরু করল সে, দুহাতে ধরে রেখেছে বাক্স।
বিকেলে, সৈকত একেবারে নির্জন নয়, কিন্তু দেখেও দেখল না যেন ছেলেরা। একটা পাথরের ধারে এসে ধপ করে বালিতে বসে পড়ল। কিশোর। হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।
সবাই এসে বসে পড়ল কিশোরকে ঘিরে।
বাক্সটা যেমন নিয়ে গিয়েছিলেন মিস্টার পারকার, তেমনিই রয়েছে, খোলার চেষ্টাও করেননি। কোমর থেকে ছুরি খুলে তিন দিক কাটা টিনের একপ্রান্তে ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে ওপর দিকে তুলে ফেলল কিশোর। সবাই ঝুঁকে এসেছে, মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি হয়ে যাচ্ছে, খেয়ালই করছে না যেন ওরা; বাক্সের ভিতর কি আছে, কার আগে কে দেখবে, সেই চেষ্টা।
টিনটা বাকা করে ফেলল কিশোর। না, ভিতরে সোনাদানা কিছু নেই। আছে কালো কাপড়ে মোড়ানো বইয়ের মত কিছু একটা। একটু যেন হতাশই হলো ওরা।
আরে, একেবারে শুকনো! ভিতরে তাকিয়ে আছে কিশোর। পুরানো আমলের কাজ, কী নিখুঁত