দুই তাকের ছোট্ট আলমারি, ভিতরে কয়েকটা জিনিস। একটা কাঠের বাক্স, পানিতে পচে ফুলে রয়েছে। গোটা তিনেক বই, ফুলে তিন গুণ হয়ে রয়েছে। একটা মদের গেলাস, ভেঙে তিন টুকরো, আরও কয়েকটা জিনিস রয়েছে-কী ছিল চেনার উপায় নেই।
নাহ, কিছু নেই, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর। তবে বাক্সটা… তুলে নিল সে ওটা। ভেতরে নিশ্চয় কিছু আছে। খুলে দেখতে হবে।
বাক্সের ডালায় দুটো ইংরেজি অক্ষর খোদাই করা: আর জি।
রিচার্ড গোবেল! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। আমার নানার-নানার-বাবা! এটা ওঁর বাক্স! নিশ্চয় মূল্যবান দলিলপত্র রয়েছে ভেতরে! খোলো, খোলা!
চেষ্টা করল কিশোর, কিন্তু তালা খুলতে পারল না। এখানে হবে না। হাতুড়ি দরকার।
চলো, বাড়ি নিয়ে যাই! চলো, চলো! তর সইছে না জিনার।
ডেকে বেরিয়ে এল ওরা। খানিক দূরে খোলা সাগরে জেলে-নৌকার ভিড়, এদিকেই তাকিয়ে আছে জেলেরা, উত্তেজিত ভাবভঙ্গি, জাহাজটা দেখে ফেলেছে।
দড়ি বেয়ে নৌকায় নামল চার অভিযাত্রী। আঙটা থেকে দড়ি খুলে দিল কিশোর, পানিতে ঝুলে রইল দড়ির মাথা, খুঁটি থেকে ফাস খোলা সম্ভব না নৌকায় বসে, দড়িটা ফেলে রেখেই যেতে হচ্ছে।
জাহাজের কাছাকাছি চলে এসেছে একটা জেলে-নৌকা। মুখের কাছে হাত জড়ো করে চেঁচিয়ে বলল গলুইয়ের কাছে দাঁড়ানো একটা লোক, এইই, শুনছ? কীসের আওয়াজ?।
পুরানো ভাঙা জাহাজ! চেঁচিয়ে জবাব দিল জিনা। ঝড়ে ভেসে এসেছে!
আর কিছু বোলো না, হুঁশিয়ার করে দিল কিশোর। চুপ! কিছু বলল না জিনা। লোকটার দিকে পেছন করে বসে দাঁড় তুলে নিল।
বাড়ি ফিরে দেখল, টেবিলে নাস্তা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মায়ের বকা খাবে ভেবেছিল জিনা, কিন্তু কিছু বললেন না মিসেস গোবেল। কোথায় গিয়েছিল ওরা জানতে চাইলেন শুধু। মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিল, জিনা বলতেই চুপ করে গেলেন।
চিকেন সুপ, ডিম ভাজা আর টোস্ট যেন নাকেমুখে গুঁজে দিয়ে শেষ করল ওরা। বাক্সটা লুকিয়ে রেখে এসেছে একটা গোলাপ ঝাড়ের তলায়। খেয়ে গিয়ে কোন এক ফাঁকে বের করে নিয়ে আসবে, উঠে যাবে ওপরতলার চিলেকোঠায়, ওখানে নিয়ে গিয়েই ভাঙবে, আলোচনা করে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে।
নয়
তিন গোয়েন্দাকে চিলেকোঠায় পৌঁছে দিয়ে নিচে নেমে গেল জিনা। বাবা কাজের ঘরে, এটো ডিশপ্লেট সরাচ্ছেন মা, খানিক পরেই রান্নাঘরে চলে। গেলেন। এই ফাঁকে বাক্সটা বের করে নিয়ে এক ছুটে ওপরে চলে এল সে।
আরেকবার তালা খোলার চেষ্টা করল কিশোর, পারল না, মুখ তুলে বলল, জিনা, একটা হাতুড়ি আর ছেনি হবে?
সবই আছে, বাবার যন্ত্রপাতির বাক্সে, জিনা বলল। দাঁড়াও, দেখি আনতে পারি কিনা।
কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এল সে, হাতে হাতুড়ি আর ছেনি। চুরি করে এনেছি। বাবা খুব ব্যস্ত, খেয়াল করেনি। পেছন দিয়ে ঢুকে টুক করে খুলে নিয়ে এসেছি, হাসল সে।
বাক্সটা মেঝেতে রেখে ডালার ওপরে ছেনি বসিয়ে হাতুড়ি দিয়ে কষে এক ঘা লাগাল কিশোর। চলটা উঠে গেল কাঠের, কিন্তু তলায়, মানে বাক্সের ভিতরের দিক শক্ত টিনের পাত দিয়ে মোড়ানো, তাতে বেধে ফিরে এল ছেনির মাথা। আবার ডালার আরেকখানে আক্রমণ চালাল সে, কাঠের চলটা উঠে গেল আরেক জায়গার। ছেনি দিয়ে ডালার অর্ধেকেরও বেশি তুলে ফেলা গেল, কিন্তু ভিতরের লাইনিং কাটেনি। ছেনি বসিয়ে জোরে বাড়ি দিয়ে দিয়ে লাইনিং কাটতে শুরু করল কিশোর, বিকট ঝনঝন আওয়াজ হচ্ছে। তিন ধার কাটা হয়ে গেল, এখন টিনের পাত টেনে ওপরের দিকে বাঁকিয়ে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কী আছে না আছে বের করে আনা যাবে। কিন্তু আনা আর হলো না। এক ঝটকায় খুলে গেল। চিলেকোঠার দরজা। জিনার বাবা! রাগে মুখচোখ লাল!
কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন তিনি, এই, কী হচ্ছে! হচ্ছে কী! সারা বাড়ি মাথায় তুলেছ! আওয়াজের চোটে ঘরে থাকতে পারছি না! বাক্সটার ওপর চোখ পড়ল তার। ওটা কী?
তাড়াতাড়ি বাক্সটা তুলে নিল মুসা।
কী ওটা? চেঁচিয়ে উঠলেন মিস্টার পারকার। কথা বলছ না কেন?
একটা বা-বাক্স… তোতলাতে শুরু করল মুসা।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি! কীসের বাক্স? দেখি? হাত বাড়ালেন। তিনি।
পিছিয়ে গেল মুসা। না, কিছু না, এমনি…
কী এমনি! দেখি! গর্জে উঠলেন মিস্টার পারকার। এগিয়ে এসে মুসার হাত থেকে বাক্স কেড়ে নিয়ে বললেন, কী সব আজেবাজে জিনিস এনে খালি ঝামেলা! শয়তানীর চোটে কাজ করা যায় না! যত্তোসব! কোথায় পেয়েছ এটা?
জা-জাহাজে…
জাহাজে! কোন্ জাহাজে?
ওই যে…মানে, যেটা ভেসে উঠেছে…
মাথায় দোষ-টোষ নেই তো! কোথায় ভেসে উঠেছে জাহাজ?
এবার রেগে গেল মুসা। দোষ থাকবে কেন? কাল ঝড় হয়েছে, দেখেননি? দ্বীপের কাছে ভেসে উঠেছে একটা ভাঙা জাহাজ, আপনাদের দ্বীপের কাছে। আপনার নানা-শ্বশুর নাকি কোন এক শ্বশুরের দ্বীপ ছিল, সেটার কাছেই তাঁর জাহাজ ডুবেছিল, ভেসে উঠেছে! রাগের ঠেলায় এক নিঃশ্বাসে সব কথা ফাস করে দিল সে।
প্রমাদ গণল সবাই।
অবাক হয়ে বাক্সটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন মিস্টার পারকারই। বিড়বিড় করলেন, হু, মূল্যবান কিছু থাকতে পারে ভেতরে! ওই জাহাজে উঠতে কে বলেছে তোমাদেরকে? নাক গলানো হয়ে গেল না?
নাক গলানো কোথায়, বাবা? বন্ধুদের অপমান সইতে না পেরে রেগে উঠল জিনা। ওটা আমার দ্বীপ, আমার জাহাজ, আমি নিয়ে গেছি ওদেরকে। হাত বাড়াল, দাও, আমার বাক্স আমাকে দাও। সোনার বার টার থাকতে পারে ওতে।