দড়ি বেয়ে বানরের মত সবার আগে ডেকে উঠে গেল জিনা। কিশোর আর মুসা উঠল তার পর। সবার শেষে রবিন। রেলিঙের কাছাকাছি এসে হাঁপ ধরে গেল তার, ওপর থেকে হাত ধরে টেনে তুলে। নিল তাকে মুসা।
এই সেই ডেক, না? বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ডেকে চোখ বোলাচ্ছে জিনা। এখানেই ঘুরে বেড়াত এক সময় জ্যান্ত মানুষ, আমার নানার-নানার বাবা! বড় একটা গর্তের দিকে আঙুল তুলল সে। ওই যে, সিঁড়ি বোধহয় ওখানেই।
গর্তটার কাছে এসে ঘিরে দাঁড়াল ওরা। সিঁড়িই। মরচে ধরা লোহার একটা মই জায়গামতই আটকে আছে এখনও।
ভার সইবে তো? দেখতে দেখতে বলল জিনা। ইস, কী অন্ধকার!
প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে আনতে সাধারণত ভুল করে না কিশোর। পাশা, কোমরের বেল্ট থেকে টর্চ খুলে হাতে নিয়ে মই বেয়ে নামতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল অন্য তিনজন সাবধানে, যদি ভেঙে পড়ে! না, ভাঙল না মই, নিরাপদেই নামল ওরা।
বিরাট খোল, বেজায় অন্ধকার, টর্চের আলোয় রহস্যময় দেখাচ্ছে। ভারি ওক কাঠে তৈরি নিচু ছাত, রবিনেরই মাথা নুইয়ে রাখতে হচ্ছে, মুসার তো আরও অসুবিধে। এখানে কেবিন ছিল নাকি? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেয়াল-টেয়াল কিছু নেই এখন, ভেঙেচুরে সব একাকার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভাঙা কাঠ। নানারকম জিনিস ছিল, সব কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে, শামুক আর শেওলার রাজত্ব। তীব্র আশটে গন্ধ, শামুক আর শেওলা পচতে শুরু করলে গন্ধ অসহ্য হয়ে উঠবে, বোঝাই যাচ্ছে।
হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে, ভীষণ পিচ্ছিল। দড়াম করে এক আছাড় খেল মুসা, এরপর পা বাড়াতেই ভয় হলো তার। এক মাথায় পাটাতনে বড় আরেকটা গর্ত দেখা গেল। আগে এখানে কেবিন ছিল, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কেবিনের মেঝেতেই গর্তটা।
ওর নিচেই বোধহয় সোনার বাক্সগুলো রাখা হয়েছিল, গর্তে আলো ফেলে বলল কিশোর। হয়তো ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। নোনা পানি আছে এখন, আর জ্যান্ত মাছ। ইচ্ছে করলে নামা যায় ওখানে, কিন্তু লাভ কী? উপুড় হয়ে শুয়ে গর্তের ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দিল সে, আলো ফেলে দেখল। না, বাক্স চোখে পড়ছে না। বড় একটা ভাঙা পিপে ভাসছে পানিতে, ভিতরে কিছু নেই।
কিশোরের পাশে শুয়ে ভিতরে উঁকি দিল জিনা। হু, পানির পিপে। মদেরও হতে পারে। কিংবা মাংস, কিংবা বিস্কুট, কিন্তু সোনা নয়। আরে, পানির তলায় ওসব কী? ও, বাঙ্ক। সাধারণ নাবিকরা থাকত ওখানে।
কোণের দিকে এক জায়গায় অনেকগুলো হুক দেখা গেল দেয়ালে, তাতে শেওলা ঝুলে রয়েছে। রান্নাঘর ছিল। বাবুর্চির কড়াই আর কাপ, প্যান ঝুলিয়ে রাখা হতো ওগুলোতে।
পুরো জাহাজটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতে লাগল ওরা। ক্ষীণ একটা আশা রয়েছে মনে, যদি বাক্সগুলো মিলে যায়! কিন্তু পাওয়া গেল না, একটা বাক্সও না, বার রাখার বাক্স তো দূরের কথা, কোনরকমের কোন বাক্সই দেখতে পেল না।
এক পাশে একটা দেয়ালের কিছু তক্তা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, দরজাটা কোথায় ছিল বোঝা যায়। বড় একটা কেবিনে এসে ঢুকল ওরা। অন্য তিন পাশের দেয়াল মোটামুটি ঠিকই রয়েছে। এক কোণে একটা বড় বাঙ্ক, তাতে নারকেলের সমান বড় এক কাকড়া শুয়ে আছে। সাড়া পেয়ে লম্বা একটা দাঁড়া বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে, খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে সিদ্ধান্ত নিল, শুয়ে থাকবে আগের মতই। আরেক কোণে কাত হয়ে পড়ে আছে একটা গোল টেবিল, দুটো পায়া নেই। কাঠের বুকশেলফ আছে, তাতে বই নেই, তার জায়গায় রয়েছে রাশি রাশি শামুক আর ঝিনুক, কুৎসিতভাবে ঝুলে রয়েছে শেওলা। দেয়ালেও শামুক আর শেওলার ছড়াছড়ি।
ক্যাপ্টেনের কেবিন, বিড়বিড় করল কিশোর। কোনায় ওটা কী?
এগিয়ে গিয়ে তুলে নিল রবিন। কাপ। আধখানা পিরিচও পড়ে আছে। জাহাজটা যখন ডুবেছিল, চা বা কফি খাচ্ছিলেন বোধহয় ক্যাপ্টেন!
এমনিতেই অস্বস্তি বোধ করছে ওরা, এই প্রাপ্তি মন আরও খারাপ করে দিল। বাতাসে আঁশটে গন্ধ স্থির হয়ে আছে যেন, পায়ের তলায় কাঠের মেঝে ভেজা, পিচ্ছিল। জিনা ভাবছে, পানির তলায়ই ভাল ছিল, কেন ভাসতে গেল জাহাজটা? গলিত লাশ কবরে মাটি চাপা থাকাই ভাল!
চলো, যাই, গলা কাঁপছে জিনার। আমার ভাল্লাগছে না! গা গুলাচ্ছে!
যাওয়ার জন্যে ঘুরল অন্য তিনজন, শেষবারের মত আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেবিনটা দেখে নিচ্ছে কিশোর। রওনা হতে যাবে, ঠিক এই সময় চোখে পড়ল জিনিসটা। আলো ওটার ওপর স্থির রেখে সঙ্গীদেরকে ডাকল, দাঁড়াও! এক মিনিট!
ঘুরে তাকাল অন্যরাও। ছোট একটা দেয়াল-আলমারির দরজা! তালার ফুটোটাই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কিশোরের।
নিশ্চয় কিছু আছে ওর ভেতরে! উত্তেজিত শোনাল তার কণ্ঠ, হাতের টর্চের আলো কাঁপছে অল্প অল্প। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে। দরজার ধারে আঙুল বাধিয়ে টান দিল। খুলল না। তালা আটকানো।
গালে আঙুল রেখে এক মুহূর্ত ভাবল কিশোর। টর্চটা মুসার হাতে দিয়ে কোমর থেকে খুলে নিল তার প্রিয় আট ফলার ছোট ছুরিটা।
একেকটা ফলা একেকটা অতি দরকারী যন্ত্র। তালা খোলার চেষ্টা করল। সে, পারল না। মরচে পড়ে আটকে গেছে। তালার পাশে খোঁচা দিয়ে দেখল, ভিজে নরম হয়ে গেছে, সামান্য খোঁচাতেই কাঠের চলটা উঠে যায়, পচে গেছে একেবারে। শেষে তালার চারপাশের কাঠ ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কেটে ফেলল সে। ক্রু-ড্রাইভারটা তালার গর্তে ঢুকিয়ে চাড় দিতেই কুট করে লক-পিন ভেঙে খুলে চলে এল তালা।