না, চুরি করেছ!
না, করিনি!
বেধে গেল ঝগড়া। টান দিয়ে লুডু ছিঁড়ে ফেলল জিনা। তাকে থামাতে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে চেয়ার উল্টে ফেলে দিল রবিন। এক ঝটকায়। খুলে গেল দরজা, জিনার বাবা, রাগে লাল চোখমুখ। ধমকে উঠলেন, এই, হচ্ছে কী!
মুহূর্তে চুপ হয়ে গেল সবাই।
খালি শয়তানি, না? চুপচাপ গল্প করো। আবার যদি গোলমাল শুনি, কাল ঘরে আটকে রাখব, বেরোতেই দেব না, হ্যাঁ। যত্তসব!, গজগজ করতে করতে চলে গেলেন তিনি।
সরি, মুসা, লজ্জিত হয়েছে জিনা।
মুসা কিছু বলতে পারল না, শুধু লজ্জিত হাসি হাসল।
বাইরে অঝোর বৃষ্টি। আকাশ কালো। সন্ধ্যা নামতে দেরি আছে, অথচ বৃষ্টির জন্যে এখনই বেশ অন্ধকার। সাগরের দিকে তাকাল কিশোর, দিগন্ত চোখে পড়ছে না, আড়াল করে দিয়েছে বৃষ্টির চাদর। আনমনেই হাত বাড়িয়ে জানালার কাছের গাছ থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে নিয়ে দাতে কাটতে শুরু করল ভেজা পাপড়িগুলো।
খেলা বা গল্প কিছুই আর জমল না। আর কিছু করারও নেই এখন। সকাল সকালই শুতে গেল ওরা। মুসা আর রবিন শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু কিশোর আর জিনার চোখে ঘুম নেই। দুজনের মনে একই ভাবনা। বৃষ্টি থামবে তো সকালের আগে? জাহাজে উঠতে পারবে? আচ্ছা, সত্যিই কি পাবে ওরা সোনার বারগুলো? সেরাতে স্বপ্ন দেখল কিশোর, জলদস্যুদের সর্দার হয়েছে সে, পালতোলা কাঠের জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে খোলা সাগরে, দিগ্বিজয়ে। জিনা দেখল দুঃস্বপ্ন, ভোরের দিকে
আট
কিশোওর! কিশোওর! বাঁচাও! বাঁচাও! আমার দম আটকে আসছে…
জিনার চিল্কারে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল রবিন। পাশের। বিছানায় ছটফট করছে জিনা। উঠে গিয়ে ঠেলা দিল, এই, জিনা, কী হয়েছে। ওঠো। দুঃস্বপ্ন দেখেছ?
চোখ মেলল জিনা। আমি পাতালঘরে বন্দি-সোনার বার…ওহ, মুখে হাসি ফুটল সহসা। স্বপ্ন দেখছিলাম! উঠে বসল সে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল ওরা, কখন বৃষ্টি থেমে গেছে। দিগন্তে পানির তলা থেকে যেন পিছলে বেরিয়ে আসছে বিশাল সূর্যটা, সাগরের পানি তো নয়, টলটলে তরল সোনা, আকাশে সাদা মেঘ রক্তাক্ত, তাতে সোনালি ছোপ। গোলাপবনে টুইই টুইই করে ডাকছে কী একটা নাম-না-জানা ছোট্ট পাখি। অপূর্ব সুন্দর এক সকাল!
কিশোরও উঠেছে। মুসাকে ঠেলা দিল, এই, এই, মুসা ওঠো। সকাল হয়েছে।
চোখ মেলল মুসা, কিশোরের দিকে চেয়ে হাসল। কেমন এক ধরনের সুখের অনুভূতি, তাদের মনে। আবহাওয়া পরিষ্কার, অভিযানে বেরোবে খানিক পরেই। বিছানা ঝাড়ল মুসা। রবিন আর জিনাকে ডাকতে চলল কিশোর, কিন্তু বারান্দায় বেরিয়েই দেখল, ওরা দুজন তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসছে।
কিশোরকে দেখেই ঠোঁটে আঙুল রাখল জিনা, জোরে কথা বোলো না! মা-বাবা নিশ্চয় এখনও ওঠেনি। দেখা হলেই হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, তার চেয়ে, চলো, না জানিয়েই বেরিয়ে পড়ি। ফিরে এসে খাব।
পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল ওরা বাড়ি থেকে।
রোদ বাড়ছে, সূর্যটা এখনও দিগন্তেই রয়েছে, পানির সামান্য ওপরে। আকাশ এত পরিষ্কার, মনে হয় যেন এই মাত্র ধুয়ে এনে ছড়ানো হয়েছে। উজ্জল নীল আকাশের পুবে সাদা মেঘের গায়ে গোলাপী রঙ লেগেছে, সাগর যেন একটা চকচকে আয়না। আবহাওয়া দেখে মনেই হয় না, গতকাল কী ভীষণ ঝড় বয়ে গেছে!
সৈকতে তিন গোয়েন্দাকে দাঁড়াতে বলে ফগের বাড়ি চলে গেল। জিনা। খানিক পরেই নৌকা বেয়ে নিয়ে ফিরে এল।
দ্বীপে রওনা হলো ওরা। দাঁড় বাইতে পরিশ্রম লাগছই না প্রায়, সাগর একেবারে শান্ত। দ্বীপের ধার দিয়ে ঘুরে অন্যপাশে নৌকা নিয়ে এল জিনা।
চোখা পাথরে কাত হয়ে আটকে রয়েছে জাহাজটা, পাথরের মতই অনড়। হালকা ঢেউয়ের তলা দিয়ে পানি আসছে-যাচ্ছে, কিন্তু জাহাজকে নড়াতে পারছে না, তার মানে ভালমতই আটকেছে। পানির তলায়ই ভাঙা ছিল অবশিষ্ট একটি মাত্র মাস্তুল, গতকালকের ঝড়ে সেটা ভেঙে আরও খাটো হয়েছে।
ইসস, কী অবস্থা হয়েছে! আফসোস করল জিনা। আরও ভেঙেছে! এটুকু যে রয়েছে, সেটাই আশ্চর্য! যা একেকখান বাড়ি খাচ্ছিল!
কিন্তু ওটার কাছে যাবে কী করে? মুসা বলল। জাহাজের চারপাশে চোখা পাথরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
দেখোই না, কী করে যাই, জিনা হাসল। তার কথা বিশ্বাস করল। তিনজনেই। গোবেল দ্বীপ আর তার চারপাশের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা হাতের উল্টোপিঠের মতই পরিচিত জিনার কাছে। দাঁড় বাওয়ার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে, কতখানি আত্মবিশ্বাস রয়েছে ওর।
কাছে চলে এল ডিঙি। বিশাল জাহাজ, দূর থেকে দেখে বোঝা যায়নি এত বড়, পানির তলায় ডুব দিয়ে তো নয়ই। জাহাজের শরীর কামড়ে ধরে রেখেছে নানারকমের ছোট-বড় শামুক। এখানে-ওখানে ঝুলে রয়েছে শেওলা, বাদামী-সবুজ, আধশুকনো। ভেজা ভেজা কেমন একটা আশটে গন্ধ ছড়াচ্ছে। জাহাজের খোলে ইয়া বড় বড় কালো ফোকর, পাথরের খোঁচায় হয়েছে। অনেক পুরানো একটা লাশ যেন, দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।
যে কটা পাথরে জাহাজ আটকে রয়েছে, তার একটার গা ঘেঁষে নৌকা রাখল জিনা। জোয়ার আসছে, ঢেউ ছলাতছল বাড়ি খাচ্ছে পাথরের গায়ে, পানির ছিটে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের জামা।
নৌকা বাধি কোথায়! এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে জিনা।
জাহাজের সঙ্গেই, কিশোর বলল। দড়িটা কোথায়? পাটাতনের নিচ থেকে খুঁজে দড়ি বের করে নিল সে। এক মাথা নৌকার গলুইয়ের আঙটার সঙ্গে বেঁধে আরেক মাথায় একটা ফাস তৈরি করল। জাহাজের ডেকের ভাঙা রেলিঙের একটা খুটি সই করে ছুঁড়ে দিল ফাসটা, আটকাল না। তিন বারের বার কাজ হয়ে গেল। টেনে ফাসটা খুঁটিতে এটে নিল। সে। দুটো কাজ হলো এতে। নৌকাও বাধা হলো, জাহাজে ওঠারও ব্যবস্থা হলো।