আরও খানিকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে জাহাজটা দেখল ওরা। তারপর ঘুরল। নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। ওদেরকে দেখেই টাওয়ার থেকে নেমে এল কাকের ঝাঁক, বাসা ভাঙা হয়েছে দেখেছে, মাথার ওপর উড়ে কা-কা করতে লাগল। গর্ত থেকে আবার বেরিয়ে এসেছে। খরগোশেরা। কাকের কা-কায় কান না দিয়ে খরগোশের গর্ত এড়িয়ে, ঝোঁপঝাড় ভেঙে, টিলা ডিঙিয়ে আবার নেমে এল ওরা প্রাকৃতিক জেটিতে। মুসা একাই নামিয়ে আনল ডিঙিটা।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা ভাল, জিনা বলল। ঢেউ এখনও বেশি। আকাশের দিকে তাকাল সে। হুমম! আবার বৃষ্টি আসবে। জোয়ারের আগে এসে গেলে মরেছি; তা হলে আজ আর বাড়ি ফিরতে পারব না।
ভাগ্য ভাল, জোয়ারের আগে এল না বৃষ্টি। ঢেউয়ের প্রতিকূলে পালা করে দাঁড় বেয়ে চলতে বেশ কষ্টই হচ্ছে ওদের।
খোলা সাগরে বেরিয়ে এল নৌকা। জাহাজটা দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে, উল্টো দিকে রয়েছে, পাহাড়ের ওপাশে।
নাহ, দেখবে না কেউ, দাঁড় বাইতে বাইতে বলল কিশোর। জিনার দিকে ফিরল। রাতে মাছ ধরতে যায় জেলেরা?
যায়। তবে আজ যাবে না। আকাশ আবার খারাপ হচ্ছে।
এই, দাঁড়টা আমাকে দাও তো, কিশোরের দিকে হাত বাড়াল মুসা। তোমার হাতে থাকলে সারাক্ষণ ওদিকেই চেয়ে থাকবে, বাড়ি ফেরা আর হবে না। এদিকে খিদেয় আমার পেট জ্বলছে।
হুফ! সঙ্গে সঙ্গে একমত হলো রাফিয়ান। মুসার হাটু ঘেষে এসে লেজ নাড়তে লাগল।
যাক, এতদিনে মনের মত দোস্ত পেয়েছ একটা, হেসে টিপ্পনী কাটল রবিন।
তীরে নেমে টেনে ডাঙার অনেক ওপরে নৌকাটা তুলে রাখল ওরা। জিনা বলল, তোমরা দাঁড়াও, আমি রাফিকে দিয়ে আসছি এক দৌড়ে!
বাড়ি ফিরতে দেরিই হয়ে গেল। খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। মিসেস পারকার, দুশ্চিন্তা শুরু করেননি এখনও।
কাপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসল ওরা। খাবারের বহর দেখে খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল মুসার। প্রথমেই কেকটা টেনে নিল সে। বড়সড় ডিশের প্রায় কানা ছুঁই ছুঁই করছে কেকের প্রান্ত। গাঢ় চকলেট রঙ, ঘি চুপচুপ করছে, চূড়ায় বড় বড় কিসমিস আর বাদাম গা ডুবিয়ে আটকে আছে, ভিতরে মোরব্বার কুচি আর কী কী আছে, অনুমান করতে কষ্ট হলো না তার। ছুরি দিয়ে বড় এক টুকরো কেটে নিয়ে কামড় বসাল। আরি, কী স্বাদ! কেক তৈরিতে মেরি চাচীকেও ছাড়িয়ে গেছেন জিনার মা।
দিনটা কেমন কাটল? হেসে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস পারকার।
খুব ভাল, খুব ভাল, মুখে কেক ভর্তি, কথা স্পষ্ট হচ্ছে না মুসার। দারুণ একখান ঝড় বইল। ধাক্কা দিয়ে সাগরের তল থেকে জা…
একসঙ্গে লাথি চালাল কিশোর আর রবিন। নাগালের মধ্যে থাকলে। জিনাও লাথি মারত। আঁউক! করে উঠল মুসা, চোখে পানি এসে গেল।
কী হলো? অবাক হলেন মিসেস পারকার। গলায় আটকেছে? এত তাড়াতাড়ি কীসের, আস্তে খাও না। নাও, পানি খেয়ে নাও। গেলাস ঠেলে দিলেন মুসার দিকে। হ্যাঁ, তারপর কী হলো?
জিনার কড়া দৃষ্টি থেকে চোখ সরাল মুসা। ও, হ্যাঁ, সাগরের তল থেকে, জানেন, কী যে বড় বড় ঢেউ…
ঢেউ সাগরের তল থেকে ওঠে নাকি? বোকা ছেলে, হাসলেন। মিসেস পারকার। জর্জের দ্বীপ দেখেছ?
নিশ্চয়। এত সুন্দর না! তবে ঝড়ের জন্যে কিছু দেখতে পারলাম না। ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম, আমার মতই রাহাউক! আবার লাথি খেয়েছে পায়ে।
জিনার মা যাতে কিছু বুঝতে না পারেন সেজন্যে তাড়াতাড়ি বলল। কিশোর, খরগোশগুলো তো একেবারে পোষা।
হ্যাঁ, আর করমোরেন্টও দেখলাম, রবিন যোগ করল। অনেক অনেক করমোরেন্ট।
আর জানো, মা, জিনা বলল, কাক এত বেশি হয়েছে না। সারাক্ষণ খালি কা-কাকা-কা, একেবারে কান ঝালাপালা…
তোরাও দেখি কাকের মতই কা-কা শুরু করে দিলি! ভুরু কোচকালেন মিসেস পারকার। নে, জলদি খেয়ে নে। তারপর চুপচাপ যার যার ঘরে চলে যা। উনি ব্যস্ত, জরুরি কাজ করছেন। চেঁচামেচি শুনলে রাগ করবেন। যাই, খাবারটা দিয়ে আসি। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই বললেন, আরে, আকাশ আবার খারাপ! জোর বৃষ্টি আসবে।
প্লেটে খাবার নিয়ে স্বামীর কাজের ঘরে চলে গেলেন তিনি।
গাবা কোথাকার! চাপা গলায় ধমক দিল কিশোর। দিয়েছিলে তো ফাস করে! মুখ সামলাতে পারো না?
হয়েছে, হয়েছে, আবার বকাবকি করছ কেন? মুসার মুখ গোমড়া, কিন্তু খাবার চিবানোয় বিরতি নেই।লাথি তো যা মারার মেরেছ, চামড়া ছড়ে গেছে পায়ের। এক কামড়ে একটা সামুসার আধখানারও বেশি মুখে পুরল সে।
হো হো করে হেসে ফেলল অন্য তিনজন। মুসার মুখ ভরা, হাসতে পারছে না, কিন্তু চোখ উজ্জ্বল।
খাওয়া শেষ করে ওপরে চলে এল ওরা। জিনা বলল, এবার তো ঘরে বন্দি। দাঁড়াও, লুডু নিয়ে আসছি।
খেলা শুরু হলো। কিশোর আর জিনা জুটি হয়েছে। প্রতিপক্ষ রবিন আর মুসা। খেলা চলছে, এক সময় প্রশ্ন করল কিশোর, আচ্ছা, জিনা, তোমাকে জর্জ বলে ডাকেন কেন তোমার মা-বাবা?
ছেলের খুব শখ ওদের, গুটি চালতে চালতে বলল জিনা। আমার একটা ভাই হয়ে মারা গেছে, তার নাম ছিল জর্জ। তার পরে আমি হয়েছি, তাই আমাকে দিয়েই পুত্রসন্তানের আশা পূরণ করে তারা, শেষ কয়েকটা শব্দ বিশেষ এক ভঙ্গিতে উচ্চারণ করল সে। আরে, আরে, একী! চেঁচিয়ে উঠল সে। আমার গুটি খেয়ে ফেলেছ? চুরি করেছ তুমি, স্রেফ চুরি!
না, চুরি করিনি! মুসাও চেঁচাল। ছক্কা উঠেছে আমার, ঠিকই খেয়েছি!