ধূসর-সবুজ ঢেউ দেখল ওরা, ঢেউয়ের মাথায় ফেনা দেখল, দ্বীপ ঘিরে পানির তা-থৈ নাচ দেখল। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়েছে মুসা আর রবিন, কিশোরের বাহু খামচে ধরে রেখেছে জিনা।
ওই যে ওদিকে, হাত তুলল কিশোর। চোখা পাথরের মাঝে। দেখেছ?
প্রথমে কিছু দেখল না, তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল জিনা, হ্যাঁ হ্যাঁ, জাহাজ! জাহাজই! বড়…অনেক বড়, সেইলিং বোট কিংবা জেলেদের বোট নয়।
ওই যে বললাম, ভুতুড়ে! ভয়ে ভয়ে বলল মুসা।
তার কথায় কান দিল না কেউ, অবাক হয়ে চেয়ে আছে জাহাজটার দিকে। পুরোপুরি ভেসে উঠেছে এখন, কালো বিশাল দেহ, দুলছে ঢেউয়ে। ধাক্কা দিয়ে দিয়ে কিনারে নিয়ে আসছে ঢেউ, খুব ধীরে ধীরে।
মরবে! কিশোর বলল। যা চোখা পাথর! তলায় খোঁচা লাগলেই খতম!
তার কথা শেষও হলো না, কাঠ ভাঙার তীক্ষ্ণ মড়মড় শব্দ উঠল, দুলে উঠে এক পাশে অনেকখানি কাত হয়ে গেল জাহাজ। দ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিমের ভয়াল ডুবোটিলার চূড়ায় বাড়ি লেগেছে। কাত হয়েই রইল জাহাজটা, তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল মস্ত একটা ঢেউ। ঢেউ সরে যাওয়ার পরও একই জায়গায় একইভাবে থেকে গেল জাহাজটা।
গেছে আটকে! কিশোর বলল। আর নড়তে পারবে না। ঝড় থামলেই পানি নেমে যাবে, ওখানে ওভাবেই আটকে থাকবে জাহাজটা।
বৃষ্টি ধরে এসেছে, তবে একেবারে থামেনি। এরই মাঝে মেঘের ফাঁকে রোদ দেখা দিল, চকিতের জন্যে। বোঝা গেল, শিগগিরই সূর্য বেরিয়ে আসবে।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এ আবার কী? এখনই ঝড়, এখনই রোদ!
গরমকালে এদিকের ঝড় এমনই, জিনা বলল। এই আছে, এই নেই।
মেঘ পাতলা হয়ে এল, ঝড়ো বাতাস মিলিয়ে গিয়ে তার জায়গায় এল ফুফুরে হাওয়া। মেঘের ফাঁকে হেসে উঠল সূর্য, উষ্ণ কোমল রোদ যেন স্বাগত জানাল ওদের। ঢেউ কমে গেছে, পানি নেমে গেছে অনেক, টিলার মাথায় আটকা পড়া জাহাজটা এখন স্পষ্ট।
অদ্ভুত! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। অদ্ভুত দেখাচ্ছে! জাহাজের এমন চেহারা…
বুঝেছি! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল জিনা। তার ধূসর চোখে আলো। উত্তেজনায় কথা আটকে যাচ্ছে।
কী! জিনার কাধ খামচে ধরল কিশোর।
কিশোর…ওটা, ওটা আমার জাহাজ! খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল জি না। আমার ডুবোজাহাজ! ঝড়-ঝড় সাগরের তলা থেকে তুলে দিয়েছে! আমার জাহাজ!
পলকে বুঝে গেল অন্যেরা, জাহাজটার এই চেহারা কেন। আধুনিক জাহাজ নয়, পুরানো কাঠের জাহাজ, পাল নেই, মাস্তুল ভাঙা। জাহাজ নয়, জাহাজের ধ্বংসাবশেষ!
ভালই হলো, জিনার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে আনল কিশোর। ভালমত খুঁজে দেখতে পারব এবার। হয়তো কে জানে, হয়তো সোনার বারগুলো পেয়েও যেতে পারি! কি বলো, জিনা?
সাত
এরপর মিনিটখানেক নির্বাক হয়ে জাহাজটার দিকে চেয়ে রইল ওরা। কালো পুরানো ভেজা ধ্বংসাবশেষের ভিতরে অসংখ্য সোনার বার! –ভাবতেই কেমন জানি লাগছে!
জিনার হাত ধরল কিশোর। কি বলো, জিনা?
তবুও জবাব দিল না জিনা, বোবা হয়ে তাকিয়ে আছে জাহাজটার দিকে। হঠাৎ করেই ফিরল কিশোরের দিকে। জাহাজটা তখন কার ছিল জানি না, হয়তো কোন রানী বা রাজার, কিন্তু এখন আমার! সাগরের তলায় ডুবে ছিল, ভেসে উঠেছে। কিশোর, ওটার ক্যাপ্টেন ছিল আমাদের নানার-নানার-বাবা। জিনিসটা তো এখন আমারই সম্পত্তি, নাকি? কেউ ছিনিয়ে নিতে আসবে না তো আবার?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারল না কিশোর। মুসা বলল, তা আসতেও পারে! তবে আমরা ওটার কথা কাউকে না বললেই হলো।
বোকার মত কথা বোলো না! জাহাজের মালিকানা হারানোর ভয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে জিনার। জেলেরা আসে, কারও না কারও চোখে পড়ে যাবেই। এত বড় একটা জাহাজ দেখতে না দেখতে রটে যাবে খবর!
তা হলে কেউ দেখার আগেই চলো ভেতরে খুঁজে দেখি, মুসা প্রস্তাব দিল। ঢেউ আরেকটু কমলেই যাব।
ঢেউ তেমন কমতে অনেক দেরি, জিনা বলল। নৌকা নিয়ে যেতে হবে। এখন যা আছে ঢেউ, তার অর্ধেক থাকলেও আছড়ে গুঁড়ো করে দেবে ডিঙি। আজ সম্ভব না।
কাল সকালে? জিনার দিকে তাকাল কিশোর। অন্য কেউ এদিকে আসার আগেই যদি চলে আসি আমরা? ভেতরে কিছু না কিছু পেয়ে যেতে
পাবে না, মাথা নাড়ল জিনা। বললাম না, ডুবুরিরা কিছু বাকি রাখেনি…
যত যেভাবেই দেখুক, বাধা দিয়ে বলল কিশোর, পানির তলায় অত খুঁটিয়ে দেখা যায় না। ওপরে অনেক ভাল করে দেখতে পারব। তা হলে কাল সকালেই, কি বলো?
হ্যাঁ, তা আসা যায়, জাহাজটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না যেন জিনা। স্বপ্নের মত লাগছে! আমি.. আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, এতকাল পর ওটা উঠে এল পানির তলা থেকে!
মেঘ কাটেনি পুরোপুরি, তার ভিতর দিয়েই সূর্য উঠেছে, রোদ বেশ কড়া। ভেজা কাপড় থেকে হালকা বাষ্প উঠতে শুরু করেছে, এমনকী রাফিয়ানের ভেজা রোম থেকেও বাষ্প উঠছে রোদের আছে। সে-ও তাকিয়ে আছে জাহাজের দিকে, থেকে থেকে চাপা স্বরে গোঁ গোঁ করছে।
কী রে জাহাজ দেখে অমন করছিস কেন? কুকুরটার মাথায় হাত রাখল জিনা। ওটা শত্রু না, লাগতে আসবে না তোর সঙ্গে।
হয়তো তিমি-টিমি ভেবেছে, হেসে বলল রবিন। জিনা, কাল সকালে কেন? আজই যাওয়া যায় না?
নাহ! আমারও খুবই ইচ্ছে করছে, কিন্তু সম্ভব না। দেখছ, জাহাজটা এখনও পুরোপুরি বসেনি পাথরের ফাঁকে? বড় ঢেউ এলেই দুলে উঠছে। পাথরে বাড়ি খেতে পারে নৌকা, আর যদি কোন অলৌকিক উপায়ে বেঁচে যাইও জাহাজে উঠতে পারব না কিছুতেই। খুবই বিপজ্জনক। খামোকা, ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী? তার চেয়ে কাল সকালেই আসব।