শার্ট খুলে চিপে নিল জিনা। আবার পরে নিয়ে বলল, এবার ফিরতে পারো।
হুঁ, সেজন্যেই চেনা চেনা মনে হয়েছে। রবিন বলল। হাসি চেনা, শুধু দাঁতের জন্যে…তবে গলার স্বর…
আমারও সন্দেহ হয়েছে, মুসা বলল। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে সব সময়, সবই করে, অথচ পানিতে নামার বেলা চুল ভিজে যাওয়ার ভয়ে নামোনি, না?
মাথা ঝোকাল জিনা।
জিনা, কিশোর বলল, গোবেল তোমার মায়ের কুলের নাম, না?
হ্যাঁ।
আবার খাওয়ায় মন দিল ওরা।
আগুন নিভু নিভু হয়ে আসছে।
আরও কুটো দরকার, জিনা বলল। ঝড় থামতে দেরি আছে। দেখি, যাই, নিয়ে আসি… বাজ পড়ার ভয়ানক শব্দে চমকে থেমে গেল।
এই ঝড় রাফিয়ানেরও পছন্দ হচ্ছে না। জিনার গা ঘেঁষে বসেছে, কান খাড়া, ব্ৰাজ পড়ার শব্দ হলেই গো গো করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাড়গোড় বা দুএক টুকরো রুটি তার দিকে ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে, টুকিয়ে টুকিয়ে খাচ্ছে সে ওগুলো।
চারটে করে বিস্কুট পড়ল একেকজনের ভাগে। জিনা বলল। আমার চারটে রাফিকে দিয়ে দাও। ওর খাওয়ার বিস্কুট আনিনি, আমারগুলোই খাক। বেচারার নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে।
আরে, দূর, তোমার সুরগুলো দেবে কেন? মুসা বাধা দিল। সবার। ভাগ থেকেই একটা করে দিই, চারটে হয়ে যাবে ওর।
তোমরা সবাই খুব ভাল, জিনা আন্তরিক গলায় বলল। সেজন্যেই এই ছুটিতে তোমাদের কথাই প্রথম মনে এল। দিলাম চিঠি লিখে। ভালই কাটছে, না?
হুফ! সবার আগে জবাব দিল রাফিয়ান। চারটে আস্ত বিস্কুট পেয়ে। হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মুখে, কুকুরে-হাসি। চার কামড়ে চারটে বিস্কুট সাবাড় করে দিল সে, তারপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে চিত হয়ে শুয়ে চার পা তুলে দিল ওপর দিকে। হেসে জিনা তার পেটে আঙুল বুলিয়ে দিল।
খাওয়া শেষ, আগুনও একেবারে কমে গেছে। মুসা আরও গোটা দুয়েক বাসা ভেঙে নিয়ে আসার জন্যে উঠল। কাধ চেপে তাকে বসিয়ে দিল কিশোর। আমি ভিজেছি, ভিজি আরেকবার। তুমি বসো। তা ছাড়া বাইরের অবস্থাও দেখার ইচ্ছে হচ্ছে। মুসা কিংবা জিনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছুটে বেরিয়ে গেল সে।
টাওয়ারের কাছে এসে দাঁড়াল। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। থেকে থেকেই বাজ পড়ছে, আকাশটাকে চিরে ফালা ফালা করে দিচ্ছে যেন বিদ্যুতের নীল শিখা। ঝড়কে ভয় করে না কিশোর পাশা, কিন্তু এই ঝড়টা অস্বস্তি জাগাচ্ছে তার মনে, কেন জানি! ভয়ঙ্কর অবস্থা আকাশ আর সাগরের। বজ্রের গর্জন মিলিয়ে যাওয়ার পর পরই কানে আসছে সাগরের হুঙ্কার। দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে, কিন্তু অনুমান করতে পারছে সে, ঢেউয়ের বড় বড় একেকটা পর্বত ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে দ্বীপের গায়ে, প্রচণ্ড শব্দে ভাঙছে, তার ছিটে উঠে আসছে এই এত ওপরে, টাওয়ারের গোড়াতেও। বৃষ্টি না থাকলে ওই ছাটের জন্যেও ভিজে যেত কিশোর। সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার! বিস্মিত গলায় আপনমনেই বিড়বিড় করলসে।
কী ভেবে ঘুরল কিশোর। ভেজা পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে দিয়ে চলে এল দেয়ালটার কাছে, যেটা এককালে পুরো দুর্গকে ঘিরে রেখেছিল, এখন জায়গায় জায়গায় ভাঙা। তেমনি একটা ভাঙা জায়গার কাছে এসে দাঁড়াল সে। সাগরের দিকে চেয়ে বোবা হয়ে গেল! এ কী দৃশ্য!
ঢেউ তো না, যেন ধূসর-সবুজ পর্বত একেকটা। ছুটে এসে গিলে। ফেলতে চাইছে ছোট্ট দ্বীপটাকে, চূড়ায় সাদা ফেনা, আকাশের বিদ্যুতের সঙ্গে চমকাচ্ছে। এত জোরে বাড়ি মারছে দ্বীপটাকে, কিশোরের ভয় হলো, ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে না দেয়! পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে বাজ পড়ার শব্দে, না ঢেউয়ের গুমরানিতে ঠিক বুঝতে পারল না।
পুরো তিরিশ সেকেণ্ড নির্বাক চেয়ে রইল কিশোর খোলা সাগরের দিকে। ধীরে ধীরে ভয় কেটে গেল; বুঝতে পারছে, এই সাগরে এর চেয়ে বড় ঢেউ আর উঠবে না, গোবেল দ্বীপকেও ভেঙে নিয়ে যেতে পারবে না। পাশ ফিরে চেয়েই স্থির হয়ে গেল সে। ঢেউয়ের খাঁজে একটা নিয়মিত সময়ে বার বার বেরিয়ে আসছে ডুবো-টিলার চোখা চূড়া, তারই ফাঁকে কালো বড় একটা অবয়ব, ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে মনে হচ্ছে। ঢেউয়ের দোলায় দুলছে; একবার, এপাশে কাত হচ্ছে, একবার ওপাশে; তলিয়ে যাচ্ছে, আবার ভাসছে। কী ওটা!
জাহাজ হতে পারে না! নিজেকে বোঝাল কিশোর বিড়বিড় করে। দ্রুত হয়ে গেছে হৃৎপিণ্ডের গতি, চোখের সমস্ত ক্ষমতা নিংড়ে নিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ভালমত, কিন্তু বৃষ্টি আর ঢেউয়ের ছটের জন্যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না কিছুতেই। অথচ জাহাজের মতই লাগছে! নাকি জাহাজই! দ্বীপে ভেড়ার চেষ্টা করছে! তা হলে মরেছে ওটা, কেউ বাঁচাতে পারবে না!
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কিশোর। কালো বস্তুটা আরেকবার ভাসল, তারপর ডুবে গেল আবার। হঠাৎ তার মনে পড়ল আগুনের কথা, নিভে গেল না তো? ফিরল সে।
আর আধ মিনিট দেরি করলেই নিভে যেত আগুন। ফিরে আসায় কোনমতে বাঁচানো গেল।
অদ্ভুত একটা জিনিস দেখে এসেছি, বলল কিশোর। জাহাজের মতই লাগল!
হাঁ করে তাকিয়ে রইল অন্য তিনজন।
জাহাজের ভূত! ঝড়ের মাঝে বেরোয়! গলা কেঁপে উঠল মুসার।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জিনা। চলো তো, দেখি! আগুনে আরও কয়েকটা কুটো ফেলে কিশোরের হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরোল সে। রবিন আর মুসা চলল ওদের পেছনে।
বাতাসের গতি কমছে, কিন্তু বৃষ্টি বেড়েছে, ঝড় সরে যাচ্ছে বোধহয়। বাজ পড়ছে এখনও, তবে অনেক দূরে, সরে যাচ্ছে আরও, বিদ্যুতের ঝলকও কমছে। ভাঙা দেয়ালটার কাছে সঙ্গীদেরকে নিয়ে এল কিশোর।