নৌকাটা আরও ওপরে তুলে রাখতে হবে, জর্জ বলল হঠাৎ।
মুসা আর রবিনকে দুর্গের ঘরে চলে যেতে বলে দ্বীপের অন্য ধারে ছুটে চলে এল কিশোর আর জর্জ, নৌকাটা যেখানে রেখেছে সেখানে। এসে ভালই করেছে, ইতিমধ্যেই নৌকার কাছে চলে এসেছে পানি, ঢেউ আরেকটু বড় হলেই ভাসিয়ে নিয়ে যেত। টেনেহিঁচড়ে নৌকাটাকে টিলার ওপরে তুলে নিয়ে এল ওরা, শক্ত করে শেকড় গেড়েছে এমন একটা ঝোঁপ দেখে তার গোড়ায় পেঁচিয়ে বাধল নৌকার দড়ি।
বৃষ্টি বেড়েছে, ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে দুজনে।
ওরা নিশ্চয় ঘরে চলে গেছে এতক্ষণে, কিশোর বলল।
হ্যাঁ, চলে গেছে। ভয় পাচ্ছে দুজনেই! বাইরে অন্ধকার, ঘরে আরও বেশি, তার ওপর ঠাণ্ডা। ভেজা কাপড়-চোপড় নিয়ে কিশোর আর জর্জের অবস্থা কাহিল।
আগুন জ্বালানো দরকার, কাঁপতে কাঁপতে বলল কিশোর। শুকনো কাঠকুটো কোথায় পাই?
তবে প্রশ্নের জবাবেই যেন কা-কা করে চেঁচিয়ে ঘরে এসে ঢুকল কয়েকটা কাক, মানুষের সাড়া পেয়ে দ্বিগুণ জোরে কা-কা করে উঠে বেরিয়ে গেল আবার।
এই তো পেয়েছি, কাঠকুটো! আনন্দে চিৎকার করে উঠল কিশোর। কাকের বাসা। দুতিনটে আনতে পারলেই কাজ চলে যাবে।
বৃষ্টির মধ্যেই ছুটে বেরোল সে। ভিজতে ভিজতে চলে এল টাওয়ারের কাছে। হ্যাঁচকা টানে সবচেয়ে নিচের বাসাটা খুলে বের করে দুহাতে জাপটে ধরে নিয়ে ছুটে চলে এল আবার ঘরে।
বাহ, চমৎকার! খুশি খুশি গলা জর্জের। ম্যাচ আর কাগজ দরকার, আছে কারও কাছে?
ম্যাচ আমার কাছেই আছে, ফায়ারপ্লেসে কুটোগুলো ছড়িয়ে রাখতে রাখতে বলল কিশোর। কিন্তু কাগজ…
আছে, আছে, বলে উঠল মুসা। স্যাণ্ডউইচের মোড়ক।
হেসে উঠল সবাই, কিন্তু কথাটা ঠিকই বলেছে মুসা। স্যাণ্ডউইচের মোড়ক খুলে নেয়া হলো, ঘি লেগে আছে, আগুন ধরাতে বরং সুবিধে হলো। কুটোগুলো গোল করে সাজিয়ে তার মাঝখানে কয়েকটা কাগজের টুকরো রাখল কিশোর, ওপরে আরও কিছু পাতলা কুটো ছড়িয়ে, একটা কাগজে আগুন ধরিয়ে তার ওপর ফেলল। প্রথমে ধোয়া উঠল কিছুক্ষণ, তারপর জ্বলে উঠল আগুন, সুন্দরভাবে।
পটপট করে কুটোর শুকনো গাঁট ফাটছে আগুনে, অন্ধকার ঘর লালচে আলোয় আলোকিত, দেয়ালে ছায়া নাচছে, কেমন যেন রহস্যময় করে তুলেছে ঘরের পরিবেশ। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কালো আকাশ, টাওয়ারের মাথায় যেন নেমে এসেছে ভারি মেঘ-ঠেকে আছে, নড়তে-চড়তে পারছে না। সাদা ছেঁড়া মেঘকে ঘোড়দৌড় করাচ্ছে বাতাস, ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে উত্তরে। সাগর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু গর্জন কানে আসছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বাতাসের তীক্ষ্ণ বাঁশি।
সাগরের পারে বাস, অথচ সাগরকে এমনভাবে গর্জাতে শুনিনি কখনও! রবিন বলল। ঝড় অনেক দেখেছি, কিন্তু এমন অবস্থা.. থেমে গেল সে।
এ আর এমন কী? জর্জ বলল। এর চেয়েও ভীষণ ঝড় হয় এদিকে। শীতকালে সবচেয়ে বেশি।
চেঁচিয়ে কথা বলতে হচ্ছে ওদের, নইলে একে অন্যের কথা শুনতে পাচ্ছে না।
অযথা বসে থেকে আর কী লাভ! মুসা প্রস্তাব রাখল। এসো, বোঝা কমাই। শেষ করে ফেলি স্যাণ্ডউইচগুলো।
অন্যেরা হাসল বটে, কিন্তু রাজি হলো।
ঝড়ের মধ্যে আগুনের ধারে বসে এভাবে খাওয়া! রবিন বলল। এর, আগে কতবছর আগে কে খেয়েছিল এখানে, কীভাবে খেয়েছিল, দেখতে ইচ্ছে করছে!
এই, মিয়া, চুপ করো, আর বোলো না! ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাল মুসা, যেন ভূত দেখতে পাবে। আমার গায়ে কাটা দিচ্ছে! সত্যি। সত্যি যদি ওনারা থেকে থাকেন!
তার শিহরণ সংক্রমিত হলো অন্যদের মাঝেও।
চুপচাপ খাওয়ায় মন দিল ওরা। মাঝে মাঝে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে লেমোনেড় দিয়ে। ভালমতই ধরেছে আগুন, উত্তাপ ছড়াচ্ছে, গরম হয়ে উঠেছে ঘর। আগুনের ধার ঘেঁষে বসল জর্জ আর কিশোর, ভেজা জামাকাপড় শুকিয়ে নিতে চায়।
আরে, বাবা, এত কষ্ট করছ কেন? মাংস চিবাতে চিবাতে বলল মুসা। কাপড় খুলে চিপে নাও না। এখানে সবাই আমরা ছেলে, লজ্জার কী আছে?
ঠিক বলেছ, শার্ট খুলতে আরম্ভ করল কিশোর।
কিন্তু জর্জ দ্বিধা করছে। শার্ট খুলল না সে, মুখ ফিরিয়ে নিল আরেক দিকে, আগুনের আরও ধার ঘেঁষে বসল। সেদিকে চেয়ে হাসল কিশোর। জিনা, আর লুকিয়ে রাখতে পারবে না নিজেকে। তা ছাড়া তোমার উইগও সরে গেছে, আসল চুল বেরিয়ে পড়েছে। আগুনের আলোয় বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু তুমি ঘরের বাইরে বেরোলেই দেখে ফেলবে ওরা।
হাঁ হয়ে গেছে মুসা আর রবিন। খাওয়া থামিয়ে বোকার মত চেয়ে রয়েছে কিশোরের দিকে। ধীরে ধীরে চোখ ফেরাল ওরা জর্জের দিকে! ও…ও জিনা? বিশ্বাস করতে পারছে না রবিন।
কেন, এখনও সন্দেহ আছে? মিটিমিটি হাসছে কিশোর।
কিন্তু ওই নাক…দাঁত… মুসার গলায় খাওয়া আটকে যাওয়ার। অবস্থা।
হাত বাড়িয়ে জিনার নাক চেপে ধরল আচমকা কিশোর, দুআঙুলে টিপে ধরে টেনে খুলে নিয়ে এল আলগা রবারের নাকটা। জিনা, সামনের দাঁত দুটো খুলে ফেললো।
কারও দিকে না চেয়ে আস্তে করে ওপরের পাটির সামনের দুটো আসল দাঁতের ওপর থেকে প্লাস্টিকের দাঁত খুলে আনল জিনা। হঠাৎ মুখ তুলে হাসল সে, ঝকঝকে দাঁত, সুন্দর মিষ্টি হাসি। যাই বলো, কিছুদিনের জন্যে তো বোকা বানাতে পেরেছি।
উঁহু, আমাকে পারোনি, মাথা নাড়ল কিশোর। শার্টটা চিপে পানি ঝরিয়ে আবার গায়ে চড়াল। আমি দেখেই চিনেছি। …ওভাবে কষ্ট করার দরকার নেই, আমরা ঘুরে বসছি। শার্ট খুলে চিপে নাও। উইগ খুলে চুল মুছে নাও।