দেখতে পাচ্ছে ছেলেরা। আরেকটা টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে এখনও, তাতে কাকের বাসা। যেখানেই ফোকর পেয়েছে, বাসা বেধেছে। খড়কুটো ছাড়া আর বিশেষ কিছু দেখা যায় না এখন টাওয়ারের।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওরা। টাওয়ারের কাছাকাছি আসতেই ভড়কে গেল একজোড়া কাক, একেবারে কাছেই ওদের বাসা, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। কা-কা চিৎকার করে মাথার ওপরে চক্কর দিতে লাগল পাখি দুটো। এই বেয়াদবিতে ভয়ানক রেগে গেল রাফিয়ান, হাউহাউ করে চেঁচিয়ে উঠল সে, লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করল কাক দুটোকে, বৃথা চেষ্টা।
ওই যে, দুর্গের কেন্দ্র, হাত তুলে দেখিয়ে বলল জর্জ। ভাঙা একটা দরজার ওপাশে পাথরের ছড়ানো চত্বর, জায়গায় জায়গায় ফাটল সেখানে ঘাস আর শেওলার রাজত্ব। দেখে মনে হয়, এক সময় ওখানে মানুষ থাকত। …ওই যে, একটা ঘর এখনও আছে। চলো, ওপাশে যাই।
দরজাটা পেরোল ওরা, ঘরটায় এসে ঢুকল। আবছা অন্ধকার। পাথরের দেয়াল, পাথরের তাক, পাথরের ছাত; এক কোণে মস্ত এক ফায়ারপ্লেস, তা-ও পাথরের। দেয়ালের অনেক ওপরে বড় বড় দুটো ফোকর, এক কালে জানালা ছিল, ওখান দিয়ে মান আলো আসছে, রহস্যময় এক আলো-আঁধারির সৃষ্টি করেছে ঘরের ভেতরে। গা ছমছম করা পরিবেশ।
যা মনে হচ্ছে, এই একটা ঘরই আস্ত আছে, ঘুরেফিরে দেখছে। কিশোর। আরেকটা দরজার কাছে গিয়ে অন্যপাশে উঁকি দিল। হুম, আরও আছে, কিন্তু আস্ত নেই কোনটাই। দেয়াল নেই, নয়তো ছাত নেই। ফিরে তাকাল সে জর্জের দিকে। ওপরতলা বলে কিছু আছে?
নিশ্চয়, কিশোরের কথার ধরনে মৃদু আহত হলো যেন জর্জ। তবে ওখানে আর ওঠা যায় না। ওই যে, দেখো, সিঁড়ি। সব আলগা। কাক টাওয়ারের ওপরেও কয়েকটা তলা আছে…ও, বুঝতে পারছ না, কাকেরা যে টাওয়ারটাতে বাস করে ওটার নাম রেখেছি কাক-টাওয়ার। কিন্তু ওখানেও উঠতে পারবে না, সিঁড়ি সব ভাঙা। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম। পড়ে গিয়েছিলাম। আরেকটু হলেই গিয়েছিল ঘাড়টা মটকে! তারপর আর সাহস করিনি।
পাতালঘর-টর আছে কিছু? আচমকা প্রশ্ন করল মুসা। আতঙ্কের দুর্গের সেই ডানজনের কথা মনে পড়ে গেছে তার।
জানি না, মাথা নাড়ল জ। তবে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। চারদিকে এত ঘাস-লতা-পাতা গজিয়েছে, থাকলেও এখন আর সিঁড়ির মুখ দেত্যই, একে ঝোঁপ; পুরনের গুল
সত্যিই, একেবারে জংলা হয়ে গেছে জায়গাটা। এখানে-ওখানে ঘন হয়ে জন্মেছে বইচির ঝোঁপ; পাথরের ফাঁকে, কোনায়, যেখানেই জায়গা পেয়েছে, ঠেলে বেরিয়েছে এক ধরনের গুল্ম; মাথায় হলদে রঙের ছোট ছোট ফুল। সবুজ ঘাসের কার্পেট যেখানে-সেখানে, মাঝে মাঝেই খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলচে-লাল সরু দণ্ডের মত উদ্ভিদ, মাথায় ছোট্ট একটা ক্রসের মত, একেকটা ক্রসের চার মাথায় আবার খুদে খুদে চারটে নীল ফুল।
না রে, ভাই, এত সুন্দর জায়গা কমই দেখেছি! আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছে অভিভূত রবিন।
দিনের বেলা সুন্দর লাগছে বটে, খাপছাড়া কণ্ঠে বলে উঠল মুসা, কিন্তু রাতে? ভূত-টুত থাকে না তো?
তোমার কথাই এমন! রেগে গেল জর্জ। খালি বাজে কথা!
বাজে কথা বললাম? তোমাদের মত কল্পনার জগতে থাকি না আমি সারাক্ষণ, আমি হলাম বাস্তববাদী…
মাথার ওপর কর্কশ চিৎকার শুনে চমকে থেমে গেল মুসা। আকাশের দিকে তাকাল।
টাওয়ারের মাথায় অনেকটা হাঁটুভাঙা-দ-এর মত হয়ে বসে ছিল। এক ঝাক বড় পাখি, চকচকে কালো পালক, কী জানি কেন একসঙ্গে উড়াল দিয়েছে, চেঁচাচ্ছে সমানে। ভয় পেয়েছে নাকি কোন কারণে?
করমোরেন্ট, বলল জর্জ। খিদে পেলেই সাগরে নামে, মাছ ধরে খায়, তারপর হজম করার জন্যে এসে বসে টাওয়ারের মাথায়।
ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে? কিশোর বলল।
জর্জ জবাব দেয়ার আগেই দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ভেসে এল চাপা গুডগুড। ঘাড় কাত করে বলল জর্জ, যা বলেছিলাম, ওই দেখো ঝড় আসছে। সেজন্যেই ভয় পেয়েছে পাখিগুলো। কিন্তু, একটু তাড়াতাড়িই এসে যাচ্ছে না! শেষ কথাটা বলতে গিয়ে আনমনা হয়ে গেল সে।
ছয়
অবাক হয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেরা। দুর্গের ভিতরটা দেখায় এতই, মনোযোগী ছিল, আর কোনদিকে নজরই রাখেনি, আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তন দেখে তাই তাজ্জব হয়ে গেছে।
আরেকবার মেঘ ডাকল। মনে হলো, আকাশের কোন এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে ভীষণ কণ্ঠে গর্জে উঠেছে হাজারখানেক বাঘ। জবাবে রাফিয়ানও গর্জে উঠল, মেঘের তুলনায় হাস্যকর মনে হলো তার চিৎকার।
এত তাড়াতাড়িই এসে গেল! জর্জ চিন্তিত। সময়মত আর বাড়ি ফিরতে পারব না। আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ।
ঠিকই বলেছে সে। ওরা রওনা দেয়ার সময় আকাশের রঙ ছিল গাঢ় নীল, এখন কালচে-ধূসর। আকাশের অনেক নিচে যেন ঝুলে রয়েছে ভারি মেঘ। ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের দল তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে দিকে দিকে, যেন তাড়া খেয়ে। মাথা কুটে একনাগাড়ে বিলাপ করে চলেছে বাতাস। ভয় পেতে শুরু করেছে রবিন।
টুপ করে বড় একটা ফোঁটা পড়ল কিশোরের কানে। বৃষ্টি আসছে! চলো, কোথাও ঢুকে পড়ি। ভিজে যাব।
আরিব্বাপ রে, ঢেউ দেখেছ! হাত তুলে বলল জর্জ। বড় রকমের ঝড় আসছে!
আকাশ চিরে ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, ক্ষণিকের জন্যে নীল আলোয়
আলোকিত করে দিয়ে গেল চারদিক।
কী সাগর বদলে কী হয়ে গেছে! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না তিন গোয়েন্দা। পাহাড়ের সমান একেকটা ঢেউ ভীমবেগে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাথুরে তীরে, কানফাটা গর্জন তুলে ভাঙছে; বালির সৈকত, পাথুরে টিলা সব ভিজিয়ে একাকার করে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার।