সবাই নীরব। অবশেষে কথা বললেন মিস্টার মিলফোর্ড, দেখো, প্লেটটা দেখো! কফিনের গায়ে আটকানো রূপার একটা পাত দেখালেন। তাতে ইংরেজিতে লেখা: ফারকোপার কৌনের প্রিয় স্ত্রী শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন এখানে।
ফারকোপারের চীনা স্ত্রী। খসখসে শোনাল চীফের কণ্ঠ।
অথচ লোকে ভেবেছে, বুড়ো মারা যাওয়ার পর চীনে পালিয়েছে মহিলা, বিড়বিড় করলেন মিস্টার মিলফোর্ড।
লোকের কথা। দেখুন দেখুন, কফিনের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল উকিল।
জিনিসটা বের করে আনল টার্নার। একটা মালা। গোল গোল পাথরের মত কিছু দিয়ে তৈরি হয়েছে। টর্চের আলোয় ভোতা ধূসর আভা বিকিরণ করছে।
এটাই বোধহয় সেই বিখ্যাত গোস্ট পার্লস, বলল উকিল। আমাদের পারিবারিক অলংকার, চীন থেকে নিয়ে এসেছিল মিস্টার ফারকোপার কৌন। অনেক দামী জিনিস। মিস্টার কৌন ঘাড় ভেঙে মরল, তার স্ত্রী নিখোঁজ হয়ে গেল। আমরা ভেবেছিলাম, হারটা নিয়ে আবার দেশে ফিরে যাওয়ার পথে কোনভাবে লাপাত্তা হয়ে গেছে মহিলা। অথচ এখানে, এই বাড়িতেই ছিল এতগুলো বছর!
চার
হেডকোয়ার্টারে কাজে ব্যস্ত মুসা আর রবিন। সবুজ ভূত সম্পর্কে খবরের কাগজে যা যা লেখা বেরিয়েছে, সবগুলোর কাটিং কেটে দিচ্ছে মুসা, আঠা দিয়ে বড় একটা খাতায় সেগুলো সেঁটে রাখছে রবিন।
সবুজ ভূত সম্পর্কে লোকের আগ্রহ কমে আসছিল, কিন্তু হঠাৎ করে পোড়ো বাড়িতে গোপন কুঠুরি, কফিনের ভেতরে বুড়ো ফারকোপারের চীনা স্ত্রীর মৃতদেহ আর মুক্তোর মালা আবার নতুন করে সাড়া জাগাল রকি বীচের লোকের মনে। প্রথম পাতায় বড় বড় হেডিং দিয়ে ছাপা হলো সেই খবর।
ফারকোপার কৌনের অতীত ইতিহাস আরও গভীরে খুঁড়ে বের করার জন্যে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল রিপোর্টারেরা। জানা গেল, চীনা জাহাজে ক্যাপ্টেনের চাকরি করেছে কিছুদিন ফারকোপার। দুর্ধর্ষ নাবিক নাকি ছিল সে, ভয়াবহ ঝড়কেও পরোয়া করত না, জাহাজ নিয়ে ঢুকে পড়ত ঝড়ের মাঝে। বেশ কয়েকজন মানচু রাজবংশীয় ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তার, প্রায়ই নানারকম মূল্যবান জিনিস তাকে উপহার দিত তারা। তবে গোস্ট পার্ল তাকে উপহার দেয়া হয়নি, ওটা সে চুরি করেছে, তারপর তাড়াহুড়ো করে স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছে, আর কোনদিন চীনে। যাওয়ার আশা ত্যাগ করে। তারপর, বাকি জীবনটা কৌন ম্যানশনে লুকিয়ে কাটিয়েছে।
ভাবো একবার, হাত থামিয়ে বলে উঠল হঠাৎ রবিন, এমন একটা লোক এই রকি বীচেই ছিল এতদিন, আর কি কাণ্ডটাই না ঘটাল। বাবা আর চীফ কি ভাবছে জানো?
ধাতব শব্দ হতেই থেমে গেল রবিন। দুই সুড়ঙ্গের মুখের লোহার পাত সরানোর আওয়াজ। চাপা খসখস শব্দ হলো কিছুক্ষণ, তারপর ট্রেলারের মেঝেতে লাগানো ট্র্যাপডোরে টোকা পড়ল।
দরজার হুড়কো সরিয়ে দিল মুসা।
গর্তের মুখে বেরিয়ে এল কিশোরের মাথা। হুফফ! মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল সে, উঠে এল। যা গরম পড়েছে।…ভাবছি।
সাবধান, কিশোর, হেসে বলল মুসা, ভাবাভাবিটা এখন একটু কমাও। নইলে মগজের বেয়ারিং জ্বলে গিয়ে শেষে আমাদের মতই ভোতামাথাদের একজন। হয়ে যাবে।
শব্দ করে হাসল রবিন।
কিশোরের মগজ সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা মুসার, কিন্তু সুযোগ পেলেই সেটা নিয়ে বন্ধুকে খোঁচা মারতেও ছাড়ে না সে। কিন্তু সাবধানী ছেলে কিশোর, এড়িয়ে যায়। মেজাজ শান্ত রাখার ক্ষমতা তার অপরিসীম।
মুসার কথা যেন শুনতেই পায়নি কিশোর, এমনি ভঙ্গিতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল তার সুইভেল চেয়ারে। ভাবছি, আবার বলল সে। ভাবায় লাভও হচ্ছে। অবশ্য। অনেক বছর আগে কৌন ম্যানশনে কি ঘটেছিল, অনুমান করতে পারছি।
তোমার কষ্ট না করলেও চলত, কিশোর, রবিন বলল। বাবা আর চীফও এ নিয়ে অনেক ভেবেছেন…
আমার ধারণা, রবিনের কথা কানে তুলল না কিশোর।
বাবা আর চীফের ধারণা, কিশোরকে কথা শেষ করতে দিল না রবিন। সে যা যা জানে, সেটা তার আগেই কিশোর বলে ফেলুক, এটা হতে দিল না। রোগে ভুগে মারা গেছে ফারকোপারের স্ত্রী। সুন্দর একটা কফিনে ভরে তাকে তখন বাড়িরই ছোট্ট একটা ঘরে রেখে দিল বুড়ো নাবিক, প্রিয়তম স্ত্রীকে দূরে সরিয়ে দিতে মন সায় দেয়নি হয়তো, মৃত্যুর পরও তাই কাছে কাছে রেখেছে। সম্ভবত করিডর দিয়ে কফিনটা সেই ঘরে ঢুকিয়েছে বুড়ো, তার জানালা দরজা ভেঙে হঁট গেঁথে বন্ধ করে দিয়েছে ফোকর। তার ওপর প্লাস্টার করে দিয়েছে। বাইরে থেকে দেখে আর বোঝার উপায় ছিল না, একটা গোপন কুঠুরি আছে ওখানে।
তারপর কতদিন বেঁচে ছিল ফারকোপার, জানা যায়নি। এক রাতে সিঁড়িতে আছাড় খেয়ে পড়ে মরল সে।
চাকরেরা বুড়োর লাশ দেখে ভয়ে রাতেই পালাল। স্যান ফ্রানসিসকোর চীনা পল্লীতে ঠাই নিয়েছিল, না দেশে পালিয়েছিল, জানা যায়নি। কারণ, স্বদেশীদের ব্যাপারে আমেরিকান পুলিশের কাছে মুখ খোলেনি চীনা-পল্লীর চীনারা।
যতদূর জানা যায়, আত্মীয় বলতে একজনই ছিল ফারকোপারের, তার ভাইয়ের স্ত্রী। স্যান ফ্রানসিসকোর ভারড্যান্ট ভ্যালিতে আঙুরখেত…
এসব পুরানো কথা, হাত তুলল কিশোর, জানি।
শেষ পর্যন্ত শোনোই না, বলে চলল রবিন। এত কাছেই থাকে, অথচ মহিলা কোন দিন ফারকোপারের বাড়িতে আসেনি। তার মেয়ে দিনারা কৌনও না। মায়ের মৃত্যুর পর আঙুরের খেত আর কৌন ম্যানশনের মালিক হয়েছে মেয়ে।