অযত্নে গজিয়ে ওঠা ঘাসে-ঢাকা ড্রাইভওয়েতে ঢুকল গাড়ি। দিনের আলোয় চমৎকার লাগছে বাড়িটাকে, একটা অংশ ভাঙা অবস্থাতেও। সদর দরজায় পাহারা দিচ্ছে দুজন পুলিশ। বাদামী স্যুট পরা এক লোক অস্থিরভাবে পায়চারি করছে ওদের সামনে। গাড়িটাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেল।
কে? বিড়বিড় করল ফ্লেচার। আরেকটা সেঁক বোধহয়।
এগিয়ে এল লোকটা। চীফ ফ্লেচার? খুব মিষ্টি কণ্ঠ। আপনি পুলিশ চীফ তো? আপনার অপেক্ষায়ই আছি। আমার মক্কেলের বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না কেন আপনার লোক?
আপনার মক্কেল? ভুরু কুঁচকে গেল পুলিশ-প্রধানের। কে আপনি?
আমি ডলফ টার্নার, পরিচয় দিল লোকটা। এ-বাড়ি মিস দিনারা কৌনের, আমি তার উকিল, দূর সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে। তার ভালমন্দ দেখাশোনার ভার আমার ওপর। সকালে খবরের কাগজ পড়েই ছুটেছি, স্যান ফ্রানসিসকো থেকে উড়ে এসেছি। আমি ভালমত তদন্ত করতে চাই। পুরো ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আমার কাছে, পাগলের প্রলাপ।
অবিশ্বাস্য, ঠিক, মাথা দোলালেন ফ্লেচার, তবে পাগলের প্রলাপ নয়। যাক, আপনি এসেছেন, খুশি হলাম, মিস্টার টার্নার। নইলে আসার জন্যে খবর পাঠাতে হত হয়তো। ও হ্যাঁ, পাহারা রেখেছি, কারণ, যখন-তখন যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে। আমার নির্দেশ আছে, কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়া হয়। তাই আপনাকে ঢুকতে দেয়নি। চলুন, এখন ঢুকি। এই যে, এই ছেলেরাও গতরাতে এসেছিল এখানে, সবুজ মূর্তিটাকে দেখেছে। এজন্যেই এখন নিয়ে এসেছি। কোথায় কোথায়। দেখা গেছে, দেখাবে আমাদের।
তিন কিশোর আর মিস্টার মিলফোর্ডের সঙ্গে টার্নারের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ফ্লেচার। তারপর সদর দরজার দিকে রওনা হলেন। পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল প্রহরীরা। বিরাট হলে ঢুকলেন তিনি, সঙ্গে অন্য পাঁচজন। আবছা আলো হলে, গা ছমছমে পরিবেশ। রবিন আর মুসা দেখাল, ঠিক কোথায় প্রথম উদয় হয়েছিল মূর্তিটা।
মুসা ওদেরকে সিঁড়ির কাছে নিয়ে এল। এই সিঁড়ির ওপর দিয়ে ভেসে হলে নেমেছিল মূর্তিটা, জানাল সে।
ভেসে বলছ কেন? প্রশ্ন করলেন পুলিশ-প্রধান।
মাটিতে পায়ের ছাপ দেখা যায়নি, সবাই খুঁজেছি। উড়ে না নামলে কি করে নামল? ছাপ খোঁজার কথা রবিনের মনে হয়েছিল। সবাই খুঁজেছি, কিন্তু ছাপ-টাপ দেখিনি।
তারপর? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার মিলফোর্ড।
উড়ে হলের ওই যে, ওখানটায় চলে গেল, হাত তুলে দেখাল মুসা, দেয়ালের কাছে। এক সময় দেয়ালের ভেতর দিয়ে ঢুকে মিলিয়ে গেল।
আঁম্ম্ন্, ভ্রূকুটি করলেন ফ্লেচার, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন।
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে উকিল। বুঝতে পারছি না কিছু? ভূতুড়ে বাড়ির কিস্সা অনেক শুনেছি। আমার বিশ্বাস হয় না ওসব।
কি বিশ্বাস হয়? ভুরু নাচালেন ফ্লেচার। কি ছিল বলে আপনার ধারণা?
চোখ মিটমিট করল উকিল। আমি কি করে জানব?
সেটা জানার জন্যেই এসেছি আমরা। আপনি আসাতে কেন খুশি হয়েছি, জানেন?
কেন?
আজ সকালে মইয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির এক জায়গায় প্লাস্টার ভাঙছিল এক শ্রমিক। এই যে, আমরা যেখানে রয়েছি, তার নিচের তলারই একটা সাইড। কিছু একটা দেখে কাজ থামিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে।
কী? সামনে ঝুঁকে এল টার্নার। কি দেখল?
ও শিওর না। তবে ওই যে দেয়ালটা, যেটা গলে ভূত অদৃশ্য হয়েছে বলেছে মুসা, সেদিকে দেখিয়ে বললেন ফ্লেচার, লোকটার ধারণা, ওটার ওপাশে একটা গোপন কুঠুরিমত আছে। আপনার অনুমতি পেলে ভেঙে ঢুকতে পারি আমরা।
কপাল ডলল টার্নার। মিস্টার মিলফোর্ডের দিকে তাকাল, তিনি তখন নোটবইয়ে নোট লিখতে ব্যস্ত। গোপন কুঠুরি? রীতিমত অবাক হয়েছে উকিল।
কই, এ বাড়িতে তেমন কোন কুঠুরি আছে বলে তো শুনিনি।
প্রচণ্ড উত্তেজনা কোনমতে দমিয়ে রেখেছে তিন কিশোর।
উকিলের অনুমতি পেয়ে কুড়াল আর শাবল নিয়ে এল দুই পুলিশ।
দেয়ালের একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন ফ্লেচার, ভাঙো।
প্রচণ্ড বিক্রমে দেয়ালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশ দুজন। একটা ফোকর করে ফেলল। বোঝা গেল, ওপাশে ফাঁপা জায়গা রয়েছে, অন্ধকার, দেখা যায় না কি আছে। আরও বড় করা হলো ফোকর, মানুষ ঢুকতে পারবে। হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ভেতরে টর্চের আলো ফেললেন ফ্লেচার।
অস্ফুট স্বরে কিছু বললেন, তারপর ফোকর গলে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। ঢুকবে। কিনা দ্বিধা করছে উকিল, কিন্তু ফ্লেচারের পেছনে মিস্টার মিলফোর্ডকে যেতে দেখে সে-ও ঢুকল। বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের উত্তেজিত কথা শুনতে পেল তিন গোয়েন্দা।
ফোকর দিয়ে উঁকি দিল কিশোর, তারপর দুই সহকারীর দিকে একবার চেয়ে সে-ও ঢুকে পড়ল। মুসা আর রবিনও ঢুকল।
ছোট একটা কক্ষ, ছয় বাই আট ফুট। দেয়ালের একটা ফাটল দিয়ে আলো আসছে, আস্তর খসানোর সময়ই নিশ্চয় ফেটেছে।
ঘরে আর কিছু নেই, শুধু একটা কফিন।
চকচকে পালিশ করা নিচু কাঠের টেবিলে রাখা আছে কফিনটা, জায়গায় জায়গায় চমৎকার খোদাইয়ের কাজ। ডালা তোলা। ভেতরের কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ফ্লেচার আর অন্য দুজনের।
পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ছেলেরাও উঁকি দিল কফিনের ভেতরে। চমকে উঠল।
একটা কঙ্কাল। পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। দামী আলখেল্লায় ঢেকে আছে। এক সময় খুব সুন্দর ছিল কাপড়টা, এখন অনেক জায়গায় নষ্ট হয়েছে দীর্ঘদিন। অবহেলায় পড়ে থেকে।