লোহালক্কড় আর বাতিল মালের জঞ্জালের তলায় লুকানো মোবাইল হোমের হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। আগের রাতে রবিনের রেকর্ড করে আনা টেপট গভীর আগ্রহে শুনছে কিশোর পাশা।
এই শেষবার, আর চিৎকার করেনি, বলল রবিন। এরপর সামান্য কিছু কথাবার্তা, লোকের। বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে সুইচ অফ করে দিয়েছিলাম, আর কিছু রেকর্ড হয়নি।
কথাবার্তা যা যা রেকর্ড হয়েছে, গভীর মনোযোগে শুনল কিশোর। রেকর্ডিংয়ের সময় মাইক্রোফোনের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়েছিল রবিন, ফলে স্পষ্ট আওয়াজ, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সব। টেপ শেষ হতেই সুইচ টিপে মেশিন থামিয়ে দিল কিশোর, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়েছে।
মানুষের গলার মতই লাগল, আনমনে বলল কিশোর। যেন সিঁড়ি থেকে গড়াতে গড়াতে পড়ছে লোকটা, শেষ মাথায় পড়ে হঠাৎ থেমে গেছে। বোধহয় খেয়াল দিইনি।
কি জানি, নিশ্চিত হতে পারছে না রবিন। তিনবার গুনেছি আমি। একবার গুনেছি ছয়জন, আর দুবার সাতজন।
কতজন, সেটা বড় কথা না, নিজের নীতিবাক্য নিজেই ভুলে গেল কিশোর-রহস্যভেদের কাছে কোন ব্যাপারকেই ছোট করে দেখা উচিত নয়, সে যত তুচ্ছই হোক। যাক, বাড়ির ইতিহাস বলো এখন।
বলছি, শার্টের গলার কাছের একটা বোতাম খুলে দিল রবিন। আজকের কাগজে বাড়িটার সম্পর্কে অনেক কথা ছাপা হয়েছে। লাইব্রেরিতে কোন বইয়ে কিছু পাইনি। কৌন ম্যানশন অনেক আগে তৈরি হয়েছে। রকি বীচে শহর গড়ে ওঠারও অনেক আগে। এ খবরের কাগজে লিখেছে, আশি-নব্বই বছর আগে বুড়ো ফারকোপার তৈরি করেছিল বাড়িটা। চীনে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, নিশ্চয়ই খুব ঘড়েল লোক ছিল। ওর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায়নি, তবে যতটা জানা গেছে, চীনে নাকি কি এক গোলমাল পাকিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল। বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল এক অপরূপ সুন্দরী চীনা রাজকুমারীকে। শোনা যায়, প্রথমে এসে উঠেছিল স্যান ফ্রানসিসকোয়, ভাইয়ের বাড়িতে। ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় রাগ করে চলে এসেছিল এই রকি বীচে।
কেউ কেউ বলে, আসলে চীন-রাজবংশের উচ্চপদস্থ কারও সঙ্গে লেগেছিল ফারকোপার কৌনের, হয়তো স্ত্রীর ভাই বা বাপ, বা ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে, সেই লোক নাকি প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিল। তাই রকি বীচে এসে বাড়ি করে লুকিয়েছিল বুড়ো। জানো তো এদিকটায় তখন বসতি গড়ে ওঠেনি, বুনোই ছিল।
কৌন ম্যানশনে বেশ রাজকীয় হালে বাস করেছে ফারকোপার। এক গাদা চাকর-বাকর ছিল। চীনের মানচু রাজবংশের লোকের মত আলখেল্লা পরতে পছন্দ করত সে, তার প্রিয় রঙ ছিল সবুজ। খাবার আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে আনিয়ে নিত ওয়াগনে করে, হপ্তায় একবার। একদিন এসে বাড়িটা খালি পেল ওয়াগনের ড্রাইভার। শুধু হলের সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে ছিল বুড়ো ফারকোপারের লাশ। ঘাড় ভাঙা।
পুলিশ এল। তাদের সন্দেহ, অতিরিক্ত মদ খেয়ে সামলাতে না পেরে সিঁড়ি থেকে পড়ে মরেছে বুড়ো। ভয়ে পালিয়েছে- চাকর-বাকরেরা। এমনকি বুড়োর বৌ-ও।
অনেক খোঁজ-খবর করল পুলিশ, কিন্তু এমন কাউকে পেল না যে কিছু জানাতে পারে। এমনিতেই চীনারা বাইরের লোকের কাছে গোপন কথা ফাঁস করে না, তখনকার দিনে আরও বেশি মুখ বুজে থাকত। কাছেপিঠে যে কয়েকজন চীনা ছিল, তাদের মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারেনি পুলিশ। বুড়োর চাকরদের কাউকে পায়নি। হয় চীনে পালিয়ে গিয়েছিল, নয়তো লস অ্যাঞ্জেলেসের চায়না টাউনে গিয়ে দেশোয়ালী ভাইদের মাঝে লুকিয়েছিল।
যা-ই হোক, পুরো ব্যাপারটা একটা রহস্য। জানামতে বুড়োর একমাত্র আত্মীয় তার মৃত ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী, আইনত তিনিই পেলেন বাড়িটা। ভারড্যান্ট ভ্যালিতে আঙুরের খেত ছিল তাঁর। কৌন ম্যানশন বিক্রির প্রস্তাব পেয়েছেন মহিলা অনেকবার, কিন্তু বিক্রি করতে রাজি হননি। বাড়িটায় এসে থাকেনওনি কোনদিন। তিনি মারা যাওয়ার পরেও ঠিক একই রকমভাবে পড়ে থাকল বাড়িটা, পড়ে পড়ে নষ্ট হলো। তারপর, এই এ-বছর মহিলার মেয়ে, মিস দিনারা কৌন বিল্ডিং ডেভেলপমেন্ট কোম্পানীর কাছে বাড়িটা বিক্রি করতে রাজি হয়েছেন। তারাই গতকাল থেকে বাড়ি ভাঙা শুরু করেছে, নতুন বাড়ি তুলবে। ব্যস, এই জানি।
হুঁ, সোজা হয়ে বসল কিশোর। কাগজগুলো দেখা যাক এবার।
কয়েকটা খবরের কাগজ টেনে নিয়ে এক এক করে টেবিলে বিছাল গোয়েন্দাপ্রধান। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা আর স্যান ফ্রানসিসকোর একটা কাগজেও খবরটা ছাপা হয়েছে, স্থানীয়গুলোতে তো হয়েছেই-বড় বড় হেডলাইন দিয়ে। লিখেছেও অনেক জায়গা নিয়ে। কেউ হেডিং দিয়েছে: চেঁচানো ভূতের ভাঙা বাড়ি পরিত্যাগ, রকি বীচে আতঙ্ক; কেউ পোড়ো বাড়ি ভাঙা শুরু, রকি বীচে সবুজ ভূতের উৎপাত; কেউ বা আবার লিখেছে, পুরানো আস্তানা ধ্বংসপ্রাপ্ত, নতুন আস্তানার খোঁজে বেরিয়েছে সবুজ ভূত।
যার যা কলমের মাথায় এসেছে লিখেছে, বানানো, রঙ চড়ানো, নানাজনের নানা মন্তব্য খুব রস দিয়ে সাজিয়েছে। তবে, আসল তথ্য সব কাগজেই প্রায় এক, রবিন একটু আগে যা বলেছে। যারা যারা ভূত দেখেছে, তাদের কথাও লেখা হয়েছে, বাদ পড়েছে শুধু পুলিশ-প্রধান ইয়ান ফ্লেচার আর তার দুই সহকারী, অফিসারের কথা। ইচ্ছে করেই খবরের কাগজওয়ালাদের কাছে নিজেদের কথা চেপে গেছে তারা, হাসির পাত্র হতে চায়নি।