কিশোর ঠিকই বলেছে, একমত হলেন মিস্টার মিলফোর্ড। আশ্চর্য! এই সহজ কথাটা আমার আর পুলিশ চীফের মাথায় এল না।
মিস কৌন ভ্রূকুটি করলেন।
কথায় যুক্তি আছে, ভুরু কুঁচকে গেছে টার্নারের, কিন্তু এই কাণ্ড কেন করতে যাবে লোকে?
দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে, জবাব দিল কিশোর। পুরানো বাড়িতে ওরকম চিৎকার শুনলে অবাক হবেই লোকে। তাছাড়া ওরকম কিছু একটা ঘটবে, আশাও করছিল ছয়জন মানুষ। বলতে গেলে, একরকম জোরজার করেই নিয়ে আসা হয়েছিল ওদের পাঁচজনকে।
হুঁ। সাজানো ব্যাপার, বললেন মিস্টার মিলফোর্ড।
এক্কেবারে, বলল কিশোর। একজন লোক ডেকে এনেছিল পাঁচজনকে, চাঁদের আলোয় পোডড়া বাড়ি দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। চাঁদের আলোয় অ্যাডভেঞ্চারের লোভেই রাজি হয়ে গিয়েছিল পাঁচজন, ছয় নম্বর লোকটাকে সন্দেহ করেনি ওরা, ধরে নিয়েছে নতুন কোন প্রতিবেশী। তার সঙ্গী তখন লুকিয়েছিল। ঝোঁপের ভেতরে। ড্রাইভওয়েতে দলটাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠছে।
চোখ মিটমিট করছে টার্নার, কিশোরের কথা বোঝার চেষ্টা করছে যেন।
মিস দিনারা কৌনের চোখে বিস্ময়। কিন্তু…কিন্তু কেন? দুজন লোক কেন ওরকম করবে?
দলটাকে বাড়িতে ঢোকানোর জন্যে, বললেন মিস্টার মিলফোর্ড। যাতে ভূত দেখে গিয়ে খবরটা ছড়াতে পারে। ভাল ফন্দি এঁটেছিল।
আমার মনে হয় না, প্রতিবাদ করল টার্নার। এসব অতিকল্পনা।
তাই? কিশোর, টেপটা চালিয়ে শোনাও ওঁকে।
রেকর্ডার রেডিই করে রেখেছে কিশোর। চালিয়ে দিল। কুৎসিত চিৎকারে ভরে গেল ঘর। লাফিয়ে উঠলেন মিস কৌন, চমকে গেল টার্নার।
এটা শুরু, মোলায়েম গলায় বললেন মিস্টার মিলফোর্ড। আরও কিছু আছে। সে-রাতে যারা যারা কথা বলেছিল, সবার কণ্ঠস্বর ধরা পড়েছে টেপে। চিনতে পারলে জানাবেন।
ভারি-কণ্ঠের কথা শুনে হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন মিস কৌন। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। হাত তুলে বাধা দিয়ে বললেন, হয়েছে, হয়েছে, আর শোনার দরকার নেই, বন্ধ করো। এই, ডলফ, এ তো তোমার গলা! ভারি করেছ ইচ্ছে করেই। সেই যে, কলেজে যখন পড়তে, নাটকে ভিলেনের অভিনয় করার সময় ওরকম করে কথা বলতে, আমি ভুলিনি।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, মাথা কেঁকাল কিশোর, মিস্টার টার্নারের গলা। প্রথমে ধরতে পারিনি, তবে চেনা চেনা লাগছিল। কৌন ম্যানশনে ওঁর কথা শুনেছি তো। বদলে ফেলেছিলেন, তবে পুরোপুরি পারেননি। সে-রাতে নকল গোঁফ পরেছিলেন। তিনি। অন্ধকারে ওইটুকুই যথেষ্ট ছিল। সহজেই বোকা বানিয়ে দিয়েছেন। পাঁচজনকে।
মুখ নিচু করে সোফায় বসে আছে টার্নার, পুরানো কাপড়ের একটা দোমড়ানো বাণ্ডিল যেন।
চুপ করে আছ কেন, ডলফ? বরফের মত শীতল মিস কৌনের কণ্ঠ। কিছু বলার থাকলে বলো।
বার কয়েক ঢোক গিলল টার্নার, অযথাই নিজের হাতের তালুর দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, তারপর শুরু করল, গোলমালটা শুরু হয়েছে বছর দেড়েক। আগে, যখন ঘোষণা করলেন, আপনার সব সম্পত্তি মিঙকে দিয়ে যাবেন। অথচ ও আসার আগে জানতাম, সব আমি পাব, গুঙিয়ে উঠল সে। কারণ মিঙ না থাকলে আপনার সব সম্পত্তির মালিক আইনত আমিই হতাম। নিজের জিনিস মনে করে ওই আঙুর খেতে আর মদের কারখানার উন্নতির জন্যে গাধার মত খেটেছি। অথচ শেষে কি হলো? মনে হলো, আমার জিনিস আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে, থামল সে।
বলে যাও, কঠিন কণ্ঠে বললেন মিস কৌন।
হাত দিয়ে কপাল মুছল টার্নার। সহ্য করতে পারলাম না। একটা ফন্দি আঁটলাম। বন্ধুবান্ধব আর ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার করলাম খেত বন্ধক রেখে, নতুন মেশিনারি কিনলাম। মরিসন আর তার কয়েক দোস্তকে টাকা খাইয়ে বশ করলাম, আমার হয়ে গোলমাল পাকাতে লাগল ওরা, যন্ত্রপাতি ভাঙতে লাগল, পিপায় ফুটো করে মদ ফেলে দিল। ক্ষতি করে করে এমন অবস্থায় নিয়ে আসতে চাইলাম, যাতে ভারড্যান্ট, ভ্যালির সবকিছু বিক্রি করে আপনি কৌন ম্যানশনে চলে যেতে বাধ্য হন।
হুঁ, তুমিই আমাকে কৌন ম্যানশন বিক্রি করতে বাধ্য করেছ, এখন বুঝতে পারছি। বলে যাও।
গভীর আগ্রহে শুনছে কিশোর। চিৎকারটা কার, বুঝেছিল সে, অনুমান করেছিল, টার্নার কোন না কোনভাবে জড়িত, কিন্তু কিভাবে, সেটা জানত না।
বাড়ির অনেক দাম উঠল, আবার বলল টার্নার, এত উঠবে কল্পনাও করিনি। বুঝলাম, ওই টাকা দিয়ে ঋণের বেশির ভাগই শোধ করে ফেলতে পারবেন। কি করব ভেবে ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েছি, এই সময় একটা মেসেজ এল।
মেসেজ? বলে উঠলেন মিস্টার মিলফোর্ড। কি মেসেজ?
স্যান ফ্রানসিসকোয় যেতে হবে একজনের সঙ্গে দেখা করার জন্যে। গেলাম। বৃদ্ধ এক চীনা, তার নাম মিস্টার হুয়াঙ। চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আমাকে, তাই কোন্ পথে গেছি বলতে পারব না। তিনি আমাকে জানালেন, ব্যাংকের কাছে রাখা ভারড্যান্ট ভ্যালির মর্টগেজ তিনি কিনে নিয়েছেন। বন্ধুবান্ধব যাদের কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলাম, তাদের সব টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। শুধু তাই না, মুখ বন্ধ রাখার জন্যে বাড়তি টাকাও দিয়েছেন তাদেরকে।
কেন? তার কি লাভ? জিজ্ঞেস করলেন মিস কৌন।
আসছি সে কথায়, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল টার্নার। তাঁর বাড়িতে বুড়ো এক চীনা চাকরানী আছে, মিস্টার ফারকোপারের বাড়িতে চাকরানী ছিল। গোস্ট পার্লের কথা সে জানে। জানে, মিস্টার ফারকোপারের স্ত্রীর লাশের সঙ্গে ওটাকে কবর দেয়া হয়েছে। মুখের ঘাম মুছল সে। মিস্টার হুয়াঙ যেন সবজান্তা। আপনার কথা, মিস্টার ফারকোপারের কথা, ভারড্যান্ট ভ্যালির কথা, সবই তার জানা। আমার সামনে টোপ ফেললেন তিনি। বুদ্ধিও বাতলালেন।