নেই! ভারি কণ্ঠ বলল। কিছু নেই ধুলোতে, কোন দাগই নেই। ওটা যা-ই হোক, বাতাসে ভেসে চলে, মাটিতে পা রাখে না!
শেষ না দেখে ফিরছি না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল বিশালদেহী নেতা। আসুন আমার সঙ্গে।
এ হলের কোণে চলে এল সবাই, এখান থেকে অদৃশ্য হয়েছে মূর্তিটা। এক পাশে দরজার পরে করিডর, শেষ মাথা গিয়ে মিশেছে আরেক ঘরের আরেকটা দরজার সঙ্গে। দুটো দরজাই খোলা। আলো ফেলে সন্দেহজনক কিছু দেখা গেল না।
আলো নিভিয়ে দিয়ে আবার অপেক্ষায় রইল ওরা। খানিক পরেই একটা দরজায় দেখা দিল মূর্তি। দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গেল হলের আরেক প্রান্তের দিকে। শেষ মাথায় গিয়ে থামল। তারপর ধীরে, অতি ধীরে আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল। রবিনের মনে হলো দেয়ালে মিশে গেল ওটা।
এবারেও পায়ের ছাপ বা বালিতে কোনরকম দাগ পাওয়া গেল না।
পুলিশ ডাকতেই হলো। দলবল নিয়ে নিজেই এসে হাজির হলেন লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ-প্রধান ইয়ান ফ্লেচার। কিছুই পেল না পুলিশও। আহত কোন মানুষ কিংবা জানোয়ার, কিছু না।
পোড়-খাওয়া পুলিশ অফিসার ইয়ান ফ্লেচার কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন, ভূত দেখেছে লোকে, কিন্তু আটজন সুস্থ মস্তিষ্ক লোকের কথা উড়িয়েই দেন। চেঁচানোর ক্ষমতা ছিল না আর।
ঠিক বলেছ! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। তা-ই ঘটেছিল পঞ্চাশ বছর আগে। সিঁড়ি থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙে মরেছিল ফারকোপার বুড়ো। পড়ার সময় নিশ্চয়ই ওরকমভাবে চেঁচিয়েছে।
এক মিনিট, আঙুল তুলল মুসা। সে তো পঞ্চাশ বছর আগের কথা। এতদিন পর কেন শোনা গেল?
হয়তো, হালকা গলায় বলল কিশোর, পঞ্চাশ বছর আগের চিৎকারটা জমে ছিল বাতাসে, এতদিন পর শব্দ হয়ে বেরিয়েছে।
দূর, ঠাট্টা কোরো না। পঞ্চাশ বছর আগের শব্দ কি করে শোনা গেল?
জানি না। রবিন, খোঁজখবর নিশ্চয়ই করেছ। শোনাও তো কৌন প্রাসাদের ইতিহাস, প্রাসাদ শব্দটা বাংলায় বলল কিশোর।
প্রাসাদ? বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল রবিন।
বাংলা। বড় বড় বাড়িকে বলে। হ্যাঁ, বলো, কৌন ম্যানশন সম্পর্কে কি কি জানলে?
লম্বা দম নিল রবিন, তারপর শুরু করল, বাড়িটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে শুনে গতকাল মুসাকে নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, পুরানো বাড়ির ওপর ভাল একটা ফিচার করে স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপতে দেব। সেজন্যেই টেপরেকর্ডার নিয়ে। গিয়েছিলাম সঙ্গে, যা যা দেখব, খুঁটিনাটি সব রেকর্ড করে রাখব, পরে লেখার সুবিধে হবে ভেবে।
চাঁদের আলোয় কেমন যেন ভূতুড়ে দেখাচ্ছিল বাড়িটা। ঢোকার পর বড় জোর পাঁচ মিনিট কাটল, তারপরই শোনা গেল প্রথম চিৎকার। মাইক্রোফোনের ভলিউম বাড়িয়ে দিলাম। তুমি আগ্রহ দেখাবে জানতাম।
খুব ভাল করেছ, বলল কিশোর। এতদিনে সত্যিকার গোয়েন্দার মত ভাবনা চিন্তা আরম্ভ করেছ। টেপে শুনেই বাড়িটা কত বড়, আশপাশে আগাছার জঙ্গল কেমন, বুঝে গেছি। লোকের কথাবার্তাও শুনেছি। ওসব আর বলার দরকার নেই, বাড়ির ভেতরে ঢোকার পর কি কি ঘটল, বলো।
বিস্তারিত জানাল সব রবিন, কিভাবে বাড়িতে ঢুকে ঘরের পর ঘর খুঁজেছে, কোথায় কিভাবে উদয় হয়েছে সবুজ ভূত, গায়েব হয়ে গেছে, সব।
এবং ভূতের পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি, যোগ করল মুসা। রবিনের মনেই প্রথম প্রশ্নটা জেগেছিল। বলতেই টর্চ নিয়ে খোঁজা শুরু করল সবাই।
ভাল, বলল কিশোর। তা কতজন লোক সবুজ জিনিসটাকে দেখেছে, মানে, তোমাদের সঙ্গে কজন ছিল?
ছজন, জানাল মুসা।
না, সাত, হাত নাড়ল রবিন।
চোখে চোখে তাকাল দুজন।
ছয়, আবার বলল মুসা, আমি শিওর। বিশালদেহী নেতা, ভারিকণ্ঠ, কুকুরের মালিক, মোটা লেন্সের চশমা পরা লোকটা, আর, আর দুজন, তাদের দিকে ভালমত কিভাবে? যা-ই হোক, একজন পুলিশকে পাহারায় রেখে দলবল নিয়ে ফিরে গেলেন। তিনি।
গভীর রাতে তাকে ফোন করল এক গুদামের দারোয়ান, সবুজ একটা জ্বলন্ত। মূর্তিকে দেখতে পেয়েছে সে। গুদামের দরজার কাছে নড়াচড়া করছিল, সে এগোতেই ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে।
সে-রাতেই থানায় ফোন করল এক মহিলা। গভীর রাতে গোঙানির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় তার। একটা রহস্যময় সবুজ জ্বলজ্বলে মূর্তিকে দেখেছে সে তার বাড়ির বারান্দায়। যেই আলো জ্বেলেছে মহিলা, সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেছে মূর্তিটা। দুজন ট্রাক-ড্রাইভার রিপোর্ট করল, তাদের গাড়ির কাছে সবুজ জ্বলন্ত মূর্তি দেখেছে।
শেষ রিপোর্ট এল পুলিশের একটা পেট্রল-কার থেকে। রেডিওতে খবর পাঠাল দুই অফিসার, রকি বীচে গ্রীন হিল গোরস্থানে একটা সবুজ মূর্তি দেখেছে ওরা। দ্রুত সেখানে এসে পৌঁছুলেন ফ্লেচার। বিরাট লোহার গেট ঠেলে ঢুকলেন গোরস্থানে। সাদা, লম্বা, একটা স্তম্ভে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন একটা সবুজ মূর্তিকে। তাকে এগোতে দেখেই যেন ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে গেল মূর্তিটা।
টর্চ জ্বেলে দেখলেন ফ্লেচার। কিন্তু আর কিছুই চোখে পড়ল না। দ্রুত এসে দাঁড়ালেন স্তম্ভের কাছে। স্মৃতিস্তম্ভ। মৃতের নাম, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ আর কিভাবে মারা গেছে, লেখা রয়েছে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না অভিজ্ঞ পুলিস প্রধান। কবরটা বুড়ো ফারকোপার কৌনের। পঞ্চাশ বছর আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙে যে মরেছিল।
দুই
ইইইইইইই-আআআআহহ! শোনা গেল, ভূতুড়ে চিৎকার, কিন্তু আঁতকে উঠল না মুসা আর রবিন, কারণ শব্দটা আসছে টেপ রেকর্ডারের স্পীকার থেকে।