কাছে এসে দাঁড়াল তিন কিশোর।
মিস্টার হুয়াঙের বৃদ্ধ, শীর্ণ হাতের তালুতে ধূসর রঙের একটা গোল জিনিস, অনেকটা মার্বেলের মত, তবে অত মসৃণ নয়।
জিনিসটা চিনল মিঙ। একটা গোস্ট পার্ল।
ভুল নাম দেয়া হয়েছে জিনিসটার, বলে বোতলের ছিপি খুলে তার। তর মুক্তোটা ফেলে দিয়ে ঝাঁকাতে লাগলেন মিস্টার হুয়াঙ। বুদবুদ উঠল কয়েক সে ণ্ড, তারপর গলে বোতলের তরল পদার্থের সঙ্গে মিশে গেল।
এর নাম রাখা উচিত ছিল, বোতলের তরল জিনিসটা গেলাসে ঢালতে ঢালতে বললেন মিস্টার হুয়াঙ, লাইফ পার্ল।
গেলাসের তরল পদার্থটুকু এক চুমুকে খেয়ে ফেললেন তিনি, যেন ওষুধ খেলেন, একটা ফোঁটাও রাখলেন না। গেলাসটা আবার রেখে দিলেন গদির নিচে গোপন কুঠুরিতে। একটা কথা অনেকেই জানে না, বললেন তিনি, হাতে গোনা কয়েকজনে শুধু জানে, তারা সবাই ধনী, জ্ঞানী। দুনিয়ার লোক জানে গোস্ট পার্ল খুব দামী। কিন্তু কেন দামী, জানে? জানে না। সাধারণ মুক্তোর মত সুন্দর নয় এই পার্ল, বরং কুৎসিতই বলা যায়। মনে হয় যেন মৃত কিছু। এজন্যেই এর নাম হয়েছে গোস্ট পার্ল।
মিস্টার হুয়াঙ কি বলতে চাইছেন, কিছুই বুঝতে পারছে না তিন কিশোর, চুপ করে রইল ওরা।
কয়েকশো বছরে, বলে গেলেন বৃদ্ধ, মাত্র কয়েকটা গোস্ট পার্ল পাওয়া গেছে, ভারত মহাসাগরের একটা বিশেষ জায়গায়। সেটাও অনেক দিন আগের কথা, তারপর আর একটাও ওরকম মুক্তো পাওয়া যায়নি। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে মাত্র ছটা গোস্ট পার্ল আছে, আর পাঁচটাই প্রাচ্যের লোকের কাছে, খুব কড়া পাহারায়। ওদের একেকজনের কত টাকা আছে, নিজেরাই জানে না। কিন্তু ওই কুৎসিত জিনিসগুলোর এত কদর কেন? কারণ, নাটকীয়ভাবে থামলেন তিনি। ওই মুক্তো খেলে আয়ু বাড়ে।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল তিন কিশোরের। যা বলছেন, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন বলেই বলছেন মিস্টার হুয়াঙ।
লম্বা দম নিয়ে আবার বললেন তিনি, শত শত বছর আগেই ব্যাপারটা আবিস্কৃত হয়েছে চীনে। প্রথমে জানত শুধু রাজ-রাজড়ারা, তারপর জানল বড় বড় জমিদারেরা, তারপর কিছু বড় ব্যবসায়ী-আমার মত লোকেরা। আমার বয়েস একশো সাত, এত দিন কিভাবে বেঁচেছি জানো? মুক্তো খেয়ে, গোস্ট পার্ল, একশোটার মত খেয়েছি। তার কালো কুতকুতে চোখের তারা মিঙের ওপর নিবদ্ধ হলো। বুঝতে পারছ, খুদে ড্রাগন, কেন নেকলেসটা আমার চাই? একেকটা মুক্তো। তিন মাস করে আয়ু বাড়ায়, নেকলেসটাতে আছে আটচল্লিশটা মুক্তো, তার মানে। আরও বারো বছর বাড়তি জীবন! কণ্ঠস্বর চড়ছে তাঁর। মুক্তোগুলো আমার চাই, যে করেই হোক, কিছুই আমাকে ঠেকাতে পারবে না। আমার পথে বাধা হলে ধুলোর মতই ঝেড়ে ফেলে দেব তোমাদেরকে। আরও বারো বছর জীবন…বুঝতেই পারছ। কত মূল্যবান আমার জন্যে।
ঠোঁট কামড়ে ধরল মিঙ। মুসা আর রবিনের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ফালতু হুমকি দিচ্ছে না। যা বলছে, করবে। দেখি দর কষাকষি করে।
দর কষাকষি করবে? শ্রবণশক্তি অত্যন্ত প্রখর মিস্টার হুয়াঙের, মিঙের কথা সব শুনেছেন। ঠিক প্রাচ্যের লোকের মত কথা বলেছ। ন্যায্য দর কষাকষিতে উভয় দিকই রক্ষা হয়। বলে ফেলো।
নেকলেসটা কোথায় আছে, মুসা যদি বলে, কিনে নেবেন? না না, আমার জন্যে বলছি না, টাকাটা দাদীমাকে দেবেন?
মাথা নাড়লেন মিস্টার হুয়াঙ। টাকা দিয়ে দিয়েছি মরিসনকে, তাকে দেব বলেছিলাম, দিয়েছি। তবে, মিঙের মুখের ভাব লক্ষ করতে করতে বললেন, একটা কাজ করতে পারি। তোমার দাদীমা আঙুর খেত আর মদের কারখানা আমার কাছে। বন্ধক রেখেছে। আমি তোমার দাদীমাকে সময় বাড়িয়ে দিতে পারি টাকা শোধ করার জন্যে, ছোট ছোট কিস্তিতে দেয়ার পরামর্শ দিতে পারি। কথা দিতে পারি, ভূতটা আর দেখা দেবে না। শ্রমিকেরা ফিরে এসে কাজে লাগবে, তোমার দাদীমা ভরাডুবির হাত থেকে রেহাই পাবে।
চোখ মিটমিট করল তিন কিশোর।
কার ভূত জানেন তাহলে? চেঁচিয়ে উঠল মিঙ। কি করে জানলেন?
মৃদু হাসলেন মিস্টার হুয়াঙ। ছোট ছোট অনেক বিদ্যেই জানা আছে আমার। নেকলেসটা কোথায় আছে মরিসনকে দেখিয়ে দাওগে, তোমার দাদীমার সব দুঃখ শেষ।
শুনতে ভালই লাগছে, মাথা ঝোকাল মিঙ। কিন্তু বিশ্বাস কি?
অবচেতনভাবে রবিন আর মুসাও মাথা ঝোঁকাল, এই প্রশ্ন তাদের মনেও।
আমি মিস্টার হুয়াঙ, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল কণ্ঠস্বর, আমার দেয়া কথা ইস্পাতের চেয়েও শক্ত।
ওনাকে জিজ্ঞেস করো, মিঙ, বলল রবিন, মরিসনকে বিশ্বাস কি?
ঠিক, সায় দিল মুসা। মরিসন যা বলে, করে ঠিক তার উল্টো। কেউটে সাপকে বরং বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু ওকে নয়।
দরজার দিকে চেয়ে ডাকলেন মিস্টার হুয়াঙ, মরিসনকে আসতে বলো।
দীর্ঘ দুই মিনিট অপেক্ষা করে রইল ছেলেরা। খুলে গেল লাল দরজা। লিফট থেকে নামল মরিসন। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, হাবভাবে অস্বস্তি প্রকাশ পাচ্ছে।
মুখ খুলেছে? ছেলেদের দিকে বুড়ো আঙুলের ইঙ্গিত করে মিস্টার হুয়াকে জিজ্ঞেস করল মরিসন।
ভদ্রভাবে কথা বলো। গর্জে উঠলেন মিস্টার হুয়াঙ। ওদেরকে অবহেলা। করবে না। তোমার মত নর্দমার কীট নয় ওরা। ড্রাগনের বাচ্চার সঙ্গে ক্রিমির যেরকম ব্যবহার করা উচিত, তেমন ব্যবহার করো।
রাগে লাল হয়ে গেল মরিসনের মুখচোখ, কিন্তু মিস্টার হুয়াঙের কালো চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা, মড়ার মুখের মত ফ্যাকাসে। সরি, মিস্টার হুয়াঙ, আমি জানতে চাইছিলাম।