খুদে ঝিঁঝি পোকা, মিঙের দিকে চেয়ে বলল বৃদ্ধ, আমার দেশী রক্ত বইছে। তোমার শরীরে। পুরানো চীনের কথা বলছি, আধুনিক চীন নয়। তোমার পূর্বপুরুষ মিশেছিল তাদের সঙ্গে। তোমার দাদার বাবা আমাদের রাজকুমারীকে নিয়ে এসেছিল। আসুক। মেয়েমানুষের ব্যাপারে আমার কোন মাথাব্যথা নেই, যাকে পছন্দ হয়েছে তার সঙ্গে এসেছে। কিন্তু তোমার দাদার বাবা জিনিস চুরি করেছিল। গোস্ট পার্ল।
এই প্রথম উত্তেজনার চিহ্ন দেখা গেল তার চেহারায়।
মহামূল্যবান মুক্তোর একটা মালা, আবার বললেন মিস্টার হুয়াঙ। প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর বছর লুকানো ছিল জিনিসটা, আবার বেরিয়েছে। ওটা এখন আমার চাই-ই। সামান্য সামনে ঝুঁকলেন। জোরাল হলো কণ্ঠ, শুনছ, খুদে ইঁদুরের ছানা? মালাটা আমার চাই।
ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছে রবিন, কারণ, নেকলেসটা তাদের কাছে নেই। চাইলেই মিস্টার হুয়াঙকে দিয়ে দিতে পারছে না।
মিঙ বলল, জনাব, জিনিসটা আমাদের কাছে নেই। আরেকজনের কাছে। হরিণের গতি তার, সিংহের হৃদয়, নেকলেসটা নিয়ে এতক্ষণে নিশ্চয়ই চলে গেছে আমার দাদীমার কাছে। আমাদের বাড়ি যেতে দিন, দাদীমাকে বলব ওটা আপনার কাছে বিক্রি করে দিতে। তবে, আমার চীনা বড় মায়ের কোন আত্মীয় এসে যদি দাবি করে…
করবে না, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মিস্টার হুয়াঙের কণ্ঠ, কারণ তেমন কেউ নেই। অন্য লোকের কারসাজি রয়েছে এতে, ব্যাপারটা ঘোরাল করে নেকলেস দখল করতে চায়। খুব ধনী এক লোক, আমার চেয়ে অনেক ধনী। একবার ওর হাতে চলে গেলে আর আমি পাব না।
বাউ করল মিঙ। মিস্টার হুয়াঙের সম্বোধন নকল করে নিরীহ কণ্ঠে বলল, আমরা খুদে ইঁদুরের ছানা, অসহায় বটে, কিন্তু আমাদের বন্ধু বাঘের বাচ্চা। ওর কাছে আছে নেকলেস। পালিয়ে যাবেই। ধনী লোকটার হাতে মালা পড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়।
মরবে! চেয়ারের হাতলে টাটু বাজাল মিস্টার হুয়াঙের আঙুল। ওকে যারা পালাতে দেবে, তারা মরবে।
আমাদের প্ল্যান বুঝে ফেলেছিল আপনার লোক, বলল মিঙ। ফাটলের কাছাকাছিই ছিল। তবে আমার মুখ চেপে ধরার আগে চেঁচিয়ে সাবধান করে দিতে। পেরেছি আমার বন্ধুকে। তাকে আর ধরতে পারবে না। মরিসন আর তার। সাঙ্গোপাঙ্গরা এত মোটা, ফাটলে ঢুকতেই পারবে না।
ঢুকতে তাদের হবেই, বললেন মিস্টার হুয়াঙ। কাল রাতে নেকলেসটা হাতিয়ে নেয়ার পর টেলিফোন করল আমাকে মরিসন, জিনিস পাওয়া গেছে। তখনই হুঁশিয়ার করেছি, গোস্ট পার্ল হাতছাড়া করা চলবে না…
থেমে গেলেন তিনি। কোথাও বেল বেজে উঠেছে। রবিনকে অবাক করে দিয়ে চেয়ারের গদির তলা থেকে ফোনের রিসিভার বের করে এনে কানে ঠেকালেন। চুপচাপ শুনে আবার রেখে দিলেন আগের জায়গায়।
অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
নীরবে অপেক্ষা করতে লাগলেন মিস্টার হুয়াঙ।
কি ব্যাপার? কৌতূহলে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়ছে রবিন। কি ঘটেছে? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন কেন মিস্টার হুয়াঙ। তাঁর হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা দেখিয়ে চমকে দিতে চাইছেন রবিন আর মিঙকে।
সম্ভব-অসম্ভব অনেক কথাই ভাবল রবিন, একটা কথা বাদে।
খুলে গেল লাল দরজা।
সারা গায়ে ধুলো-ময়লা, ফ্যাকাসে চেহারা, টলোমলো পায়ে ঘরে এসে ঢুকল মুসা আমান।
তেরো
মুসাআ! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন আর মিঙ। তুমি ঠিক আছো?
খুব খিদে লেগেছে, করুণ হয়ে উঠল মুসার চেহারা। হাতটা ব্যথা করছে। মরি ননের বাচ্চা মুচড়ে ধরেছিল, নেকলেসটা কোথায় রেখেছি বলিনি, সেজন্যে।
হারটা তাহলে লুকিয়ে ফেলেছ? উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
কাউকে বলোনি তো? যোগ করল মিঙ।
নাআ, বলিনি, হাসি ফুটল মুসার চোখে। গুহায় লু…
চুপ! চেঁচিয়ে উঠল মিঙ। বোলো না। শুনছে। নীরব হয়ে গেল মুসা। এই প্রথম চোখ পড়ল মিস্টার হুয়াঙের ওপর।
তুমি খুদে ইঁদুর নও, মিঙের দিকে চোখ ফেরালেন মিস্টার হুয়াঙ, ভুল বলেছি। তুমি একটা ড্রাগনের বাচ্চা, ঠিক তোমার দাদার বাপের মত, হাড়ে হাড়ে শয়তান। এক মুহূর্ত চুপ থেকে কি ভাবলেন, তারপর তিন কিশোরকে অবাক করেদিয়ে যেন বোম ফাটালেন, তুমি আমার ছেলে হবে? পালকপুত্র? আমি ধনী, অনেক টাকার মালিক, কিন্তু আমার ছেলেপুলে নেই। তোমার মত একটা ছেলে পেলে…হবে? আমার সব সম্পদ দান করে দিয়ে যাব। আরামে কাটাতে পারবে বাকি জীবন।
হতে পারলে খুব খুশিই হতাম, শান্ত কণ্ঠে বলল মিঙ। কিন্তু দুটো খারাপ কাজ করতে হবে আমাকে।
কি কি?
এক: আমার বন্ধুদের সঙ্গে বেঈমানী করে গোস্ট পার্ল আপনার হাতে তুলে দিতে হবে।
মাথা ঝোঁকালেন মিস্টার হুয়াঙ। আমার ছেলে হলে সেটা তোমার কর্তব্য।
দুই নম্বর: নেকলেসটা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা আপনি ভুলে যাবেন, আমাকে পালকপুত্র করার ধারেকাছেও যাবেন না।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিস্টার হুয়াঙ। আমি বলামাত্র যদি রাজি হয়ে যেতে, হয়তো ভুলে যেতাম। কিন্তু এখন? এখন সত্যিই তোমাকে ছেলে হিসেবে পেতে চাই।
না, মিস্টার হুয়াঙ, মাপ করবেন। দুনিয়ার তাবৎ ধনের বিনিময়েও বন্ধুদের সঙ্গে বেঈমানী করতে পারব না আমি।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন মিস্টার হুয়াঙ, রাজি হলে ভাল করতে। যাকগে। মনের ওপর তো আর জোর চলে না। তবে দরকার হলে নেকলেস আমি জোর করেই আদায় করব। গদির তলায় হাত দিয়ে চেয়ারে লাগানো গোপন কুঠুরি থেকে একটা ছোট বোতল, কাঁচের গেলাস আর গোল একটা জিনিস বের করে আনলেন। কাছে এসো, দেখে যাও।