যেমন সহসা শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল কম্পনটা। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে মাথার কাছ থেকে পাথরটা এক পাশে সরিয়ে দিল মুসা।
মিনিট খানেক চুপচাপ অপেক্ষা করল সে, তারপর আবার চলতে শুরু করল। কাঁপুনিটা কেন শুরু হয়েছিল, বুঝতে পেরেছে। কোথাও ছোটখাট ভূমিকম্প হয়ে গেছে, তারই রেশ এসে পৌঁছেছে এখানে।
ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় সবাই জানে, মুসাও জানে, বিখ্যাত স্যান অ্যানড্রিয়াস ফল্ট-পাথুরে ভূত্বকের এক মস্ত চিড়-চলে গেছে পশ্চিম ক্যালিফোর্নিয়ার নিচ দিয়ে। উনিশশো ছয় সালে ওই ফল্টের কারণেই ভয়ংকর ভূমিকম্প হয়েছিল স্যান ফ্রানসিসকোয়। উনিশশো চৌষট্টি সালে আলাসকায় মহাভূমিকম্প ঘটিয়েছিল ওটাই। সেসময় ওখানকার ভূপৃষ্ঠ কোথাও কোথাও তিনশো ফুট ঠেলে উঠেছিল, কোথাও বসে গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি। প্রতি বছরই কমবেশি ভূমিকম্প হয় ওই ফল্টের কারণে, বছরে অসংখ্যবার, তবে তেমন মারাত্মক নয়।
জোরে জোরে দম নিচ্ছে মুসা। পেরিয়ে এল সঙ্কীর্ণ সুড়ঙ্গ। চিহ্ন ধরে ধরে চলে এল সেই গুহাটায়, যেটা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল।
গুহাটা খালি। নীরব। বাইরে অন্ধকারের কালো চাদর, রাত নেমেছে।
সাবধানে, নিঃশব্দে গুহামুখের দিকে এগোল সে। টর্চ নিভিয়ে দিয়েছে। কয়েক কদম এগিয়েই থেমে কান পেতে শুনছে সন্দেহজনক শব্দ পাওয়া যায় কিনা। আশা করছে, এখনও গুহামুখটা খুঁজে পায়নি শত্রুরা।
গুহামুখের বাইরে বেরোল মুসা। তাকাল তারাজ্বলা আকাশের দিকে।
এই সময় পাথরের আড়াল থেকে কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। শক্তিশালী বাহু জড়িয়ে ধরল তাকে, মুখ চেপে ধরল একটা কঠিন থাবা।
বারো
একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে মিঙ আর রবিনকে। জানালা নেই, শুধু একটা। দরজা, তা-ও তালা দেয়া, চেষ্টা করে দেখেছে দুজনে, খুলতে পারেনি।
এ দুজনেরই কাপড়ে বালি, ময়লা, সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দেয়ার সময় লেগেছে। ঝেড়েমুছেও বিশেষ সুবিধে হয়নি, সাফ হয়নি ময়লা। দুজনেই গোসল করে নিয়েছে। শুধু তাই না, ভরপেট খেয়েছেও। চমৎকার রান্না করা চীনা খাবার।
খিদের জন্যে কথা বলার ইচ্ছেই হয়নি এতক্ষণ, পেট ঠাণ্ডা হতে আরাম করে বসে আলোচনা শুরু করল।
আছি কোথায় কে জানে? বলল রবিন, গত কয়েক ঘণ্টার উত্তেজনা অনেকখানি দূর হয়ে গেছে।
বড় কোন শহরের তলায়, বলল মিঙ। স্যান ফ্রানসিসকো হতে পারে।
কি করে বুঝলে? চোখ বেঁধে এনেছে, আমি তো কিছুই দেখিনি, তুমি দেখেছিলে?
না। অনুমান। মাঝে মাঝেই ছাত কেঁপে উঠছে, খেয়াল করছ না? ট্রাক যাচ্ছে। ওপর দিয়ে। আর ট্রাক মানেই বড় শহর। চীনা চাকরেরা এই ঘরে নিয়ে এসেছে। আমাদের, চীনা খাবার খাইয়েছে। সারা আমেরিকায় স্যান ফ্রানসিসকোতেই রয়েছে। সবচেয়ে বড় চায়না টাউন। কোন মস্ত বড় লোকের বাড়িতে বন্দি হয়েছি আমরা।
কি করে জানলে?
খাবার। রান্না দেখোনি কি চমৎকার? এত ভাল রাঁধতে হলে খুব ভাল বাবুর্চি দরকার, আর সে-রকম বাবুর্চি রাখতে অনেক টাকা লাগে।
কিশোরের সহকারী তোমারই হওয়া উচিত ছিল, আন্তরিক প্রশংসা করল রবিন। রকি বীচে থাকলে তোমাকে দলে নিয়ে নিত সে।
আমিও খুশি হয়ে যোগ দিতাম। ভারড্যান্ট ভ্যালিতে বড় একা একা লাগে, আমার বয়েসী কেউ নেই তো। হঙকঙে খুব আরামে ছিলাম, বন্ধুরা ছিল, কত খেলেছি। কিন্তু দাদীমার ওখানে…আর খেলার কথা ভেবে কি হবে, এখন হঙকঙও যা, ভারড্যান্ট ভ্যালিও তা।
মিঙের কথা বুঝতে পারছে রবিন। এখান থেকে বেরোতেই যদি না পারে, কোন্ জায়গা ভাল আর কোন্ জায়গা খারাপ, তা দিয়ে কি হবে?
দরজা খোলার শব্দে ভাবনায় বাধা পড়ল। এক বুড়ো চীনা, পরনে প্রাচীন চীনের পোশাক, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
এসো, ডাকল লোকটা।
কোথায়? গম্ভীর হয়ে বলল মিঙ।
বন্দির কোন প্রশ্ন করা উচিত নয়। এসো। দৃঢ়, বলিষ্ঠ পায়ে এগিয়ে গেল মিঙ, তাকে অনুসরণ করল রবিন।
বুড়ো চীনার পেছনে পেছনে লম্বা করিডর পেরিয়ে খুদে একটা লিফটে উঠল ওরা। অনেক উপরে উঠে একটা লাল দরজার সামনে থামল লিফট। দরজা খুলে পাশে সরে দাঁড়াল বুড়ো, হাত নেড়ে বলল, যাও। যা যা জিজ্ঞেস করা হবে, ঠিক ঠিক জবাব দেবে, যদি ভাল চাও।
বিশাল এক গোল হলরুমে ঢুকল ওরা। দেয়াল ঢাকা মূল্যবান, কাপড়ে, সোনালি সুতো দিয়ে সুচের নানা রকম কাজ: ড্রাগন, চীনা মন্দির, উইলো গাছ, আর আরও নানারকম সুদৃশ্য ছবি। এক জায়গায় কিছু উইলো গাছ ঝড়ে দুলছে, একেবারে জ্যান্ত মনে হয়।
খুব পছন্দ হয়েছে, না? হালকা, বয়স্ক কিন্তু স্পষ্ট কণ্ঠস্বর। পাঁচশো বছর আগের তৈরি।
ফিরে চেয়ে দেখল, ওরা একা নয়। কারুকাজ করা বিরাট এক কাঠের চেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। কালো রঙ করা চেয়ার, কোমল পুরু গদি।
বৃদ্ধের পরনে ঢোলা আলখেল্লা, প্রাচীন চীনা সম্রাটরা যেমন পরতেন। ছোট্ট, হলদেটে মুখ, চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।
এগোও, শান্ত কণ্ঠে বললেন তিনি, খুদে বিচ্ছুর দল। অনেক ঝামেলা করেছ। বসো।
গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটে এল ছেলেরা, এত পুরু যে গোড়ালি ডুবে যায়। ছোট দুটো টুল আছে, ওদের জন্যেই এনে রাখা হয়েছে বোধহয়। বসল। অবাক হয়ে তাকাল বৃদ্ধের দিকে।
আমি হুয়াঙ। বয়েস একশো সাত।
বিশ্বাস করল রবিন। এত বয়স্ক লোক আর দেখেনি। বয়েসের তুলনায় বেশ তাজা এখনও মিস্টার হুয়াঙ।