সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল ওরা। সরু পথ, মাঝে মাঝে ছাত এত নেমে এসেছে, মাথা ঠেকে যায়, নিচু হয়ে চলতে হয়। কোথাও কোথাও সুড়ঙ্গটাকে ভেদ করে আড়াআড়িভাবে চলে গেছে আরও সুড়ঙ্গ, কিংবা মূল সুড়ঙ্গ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শাখা-সুড়ঙ্গ। ওই সব সুড়ঙ্গমুখে উল্টো পাল্টা তীর চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে। রবিন, যেটা ধরে যাচ্ছে, সেটার মাঝে মাঝে দেয়ালে আশ্চর্যবোধক আঁকছে, একবার। এপাশের দেয়ালে, একবার ওপাশের। এমনভাবে আকছে, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যাবে যে কেউ, ওরা নিজেরা বাদে।
একটা জায়গায় খুব সঙ্কীর্ণ হয়ে এল সুড়ঙ্গ, তার ওপর পাথর ধসে পথ প্রায় রুদ্ধ।
থামতে বলল মিঙ। ক্রল করে যেতে হবে। আমি আগে যাই। কোমরের বেল্টে গোঁজা কালো টর্চটা, যেটাতে নেকলেস ভরা আছে, সেটা টেনে খুলে মুসার হাতে গুঁজে দিল সে। এটা তোমার কাছে রাখো। পাথর আর মাটি সরিয়ে পথ করে নিতে হতে পারে। হারানোর ভয় আছে। যত্ন করে রাখো।
মুসাও কোমরের বেল্টের ভেতর গুঁজে রাখল টর্চটা, বাকলস আরও টাইট করে দিল, যাতে পড়ে না যেতে পারে মহামূল্যবান জিনিসটা। আমার হাতে আরেকটা টর্চ থাকলে ভাল হত।
তা হত, স্বীকার করল মিঙ। দুটো আছে, এই অন্ধকারে আরেকটা থাকলে কাজে লাগত। রবিন, এক কাজ করো না, তোমারটা দিয়ে দাও মুসাকে। তুমি আমার পেছনে থাকো, তাহলে তোমার আর টর্চের দরকার পড়বে না। কি বলো?
মাথা কাত করল বটে রবিন, কিন্তু মনে মনে মেনে নিতে পারছে না ব্যাপারটা। এই অন্ধকারে সবচেয়ে যেটা বেশি দরকার, সেটা আলো। কিন্তু অযৌক্তিক কথা বলেনি মিঙ, মুসার হাতে টর্চটা দিল রবিন। তারপর মিঙের পেছনে ক্রল করতে গিয়ে বুঝল, ঠিক কাজই করেছে। হাতে কিছু না থাকায় কাজটা সহজ হয়ে গেছে তার জন্যে।
সুড়ঙ্গের সরু অংশটা বড় জোর শখানেক গজ লম্বা, অথচ এটুকু পেরোতেই ওদের মনে হলো অসীম পথ, শেষ আর হতে চায় না। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে চলেছে ওরা। রবিন আর মুসার অবস্থা যেমন তেমন, মিঙের অবস্থা কাহিল। সামনের পাথর দুহাতে সরিয়ে পথ করে নিতে হচ্ছে তাকে। ধারাল পাথরে লেগে চামড়া কেটে রক্তাক্ত হয়ে গেছে হাত।
দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে রবিনের। কিন্তু সোজা হয়ে বসারই উপায় নেই, দাঁড়াবে কিভাবে? একবার সেটা করতে গিয়ে অল্পের জন্যে বেঁচেছে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে উঠতে চেয়েছিল, তাতেই বিপত্তি, কাঁধের ধাক্কায় ধসে পড়ল ছাতের আলগা পাথর, ঝরঝর করে পড়ে প্রায় ঢেকে দিল রবিনকে। আটকে গেল সে, নড়তে পারল না, পেছন থেকে এসে অনেক কষ্টে পাথর সরিয়ে তাকে মুক্ত করল মুসা।
ধন্যবাদ, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল আতঙ্কিত রবিন। আর দাঁড়ানোর চেষ্টা নয়।
অবশেষে চওড়া হতে শুরু করল সুড়ঙ্গ। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে হাপাতে লাগল ওরা। টর্চের আলোয় দেখা গেল, ছাতের কাঠের কড়িবর্গা পাথরের চাপে বাঁকা হয়ে গেছে, একটুখানি ঠেলা বা ধাক্কা লাগলেই ধসে পড়তে পারে। তাহলে পাথরের তলায় জ্যান্ত কবর হয়ে যাবে ওদের।।
খানিকক্ষণ একইভাবে বসে জিরিয়ে নেয়ার পর বলল মিঙ, সবচেয়ে খারাপ জায়গাটা পেরিয়ে এসেছি। সামনে আরেকটা আছে, তবে পেছনের মত এত খারাপ নয়। ওটা পেরোতে পারলেই… হাসল সে। একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম। ওই পথে আমাদের পিছু নিতে পারবে না মরিসন, ওই সুড়ঙ্গে জায়গাই হবে না তার, গলে বেরিয়ে আসতে পারবে না, আটকে যাবে।
বিশ্রাম নিতে নিতে খনির ইতিহাস বলল মিঙ। আঠারোশো ঊনপঞ্চাশ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় যখন স্বর্ণ আবিষ্কার হয়, তখন খোঁড়া শুরু হয় এই খনি। শুরুর দিকে সহজেই সোনা মিলতে লাগল, ফুরিয়ে আসার পর বেশির ভাগ শ্রমিকই চলে গেল অন্যত্র, কিন্তু কেউ কেউ রয়ে গেল, ওরা বেশি পরিশ্রমী। পাহাড়ের তলায় খুঁড়ে খুঁড়ে সুড়ঙ্গের জাল বানিয়ে ফেলল।
ভারড্যান্ট ভ্যালিতে তার আগে থেকেই আঙুরের চাষ হত। তারও অনেক পরে ওখানে আঙুরের খেত কিনলেন মিস দিনারা কৌনের মা।
তিরিশের দশকের পরেও টিকে ছিল কিছু কিছু খনিশ্রমিক, তারপর উনিশশো চল্লিশে আর সোনা পাওয়া গেল না, একে একে চলে গেল যারা তখনও ছিল। কেউ কেউ খনি খোঁড়া বাদ দিয়ে আঙুরের ফার্মে কাজ নিল।
এখন আর সোনা আছে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
আছে, খুব অল্প। তবে সেটা তুলতে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি বলে কেউ আর এগিয়ে আসছে না, বলল মিঙ। জিরানো হয়েছে। চলো যাই।
আবার এগোনোর পালা। দেয়ালে আশ্চর্যবোধক আর তীর চিহ্ন এঁকে চলল রবিন।
একটা জায়গায় এসে থমকে গেল মিঙ। কয়েকটা সুড়ঙ্গ এক জায়গায় মিলিত হয়েছে মূল সুড়ঙ্গের সঙ্গে। কোষ্টা দিয়ে যেতে হবে, ভুলে গেছে সে। অবশেষে ভানের, একটা সুড়ঙ্গ বেছে নিয়ে তাতে ঢুকে পড়ল। কিন্তু ভুল করেছে। তিনশো গজ গিয়ে সরু হতে হতে মিলিয়ে গেছে সুড়ঙ্গ।
ভুল পথে এসেছি, টর্চের আলো জ্বেলে দেখছে মিঙ। সুড়ঙ্গের মেঝেতে এক জায়গায় আলো ফেলে চেঁচিয়ে উঠল, দেখো দেখো।
দেখল রবিন আর মুসা। আলোয় মৃদু চকচক করছে শাদা হাড়। প্রথমে মনে। হলো, মানুষের হাড়। কিন্তু ভাল মত দেখে বুঝল, কোন জানোয়ারের, বোধহয় আটকা পড়ে গিয়েছিল এখানে, ঢুকে কোন কারণে আর বেরোতে পারেনি, ক্ষুধাতৃষ্ণায় মরেছে।