দুটো হলুদ পাথরের দেখা পেলে এখন হয়, বলল মিঙ, চিহ্ন। গিরিপথ থেকে বিশ ফুট ওপরে একটা, আরেকটা তার ওপরে।
মিনিট দশেক একটানা চলল ওরা। তিনজনের মাঝে দৃষ্টিশক্তি বেশি তীক্ষ্ণ মুসার, সে-ই আগে দেখল পাথর দুটো। হাত তুলে বলল, ওই দুটো?
মাথা ঝাঁকাল মিঙ। পাথর দুটোর নিচে এসে ঘোড়া থেকে নামল। নামমা।
দুই গোয়েন্দাও নামল। তাদেরকে অবাক করে দিয়ে ঘোড়াগুলোর গায়ে চাপড় মেরে বসল মিঙ। চমকে উঠে পেছন ফিরে দৌড়াতে শুরু করল কোল্ট, অন্য দুটো অনুসরণ করল তাকে।
হাঁটতে হবে এখন, বলল মিঙ। দরকার পড়লে ক্ৰলও করতে হতে পারে। গিরিপথ ওদিকে বন্ধ, পেছনে দেখাল সে। এক জায়গায় ছোট একটা ডোবা আছে। পানির গন্ধ শুঁকে এগিয়ে যাবে ঘোড়াগুলো, পানি খেয়ে বিশ্রাম করবে ওটার পাড়েই। মরিসন যখন বুঝতে পারবে আমরা তাকে ফাঁকি দিয়েছি, খুঁজতে আসবে, ঘোড়াগুলো দেখবে, আমরা তখন কয়েক ঘণ্টার পথ দূরে। ওপর দিকে তাকাল। সে। ওখান দিয়ে একটা পথ গেছে জানি, অনেকটাই মুছে দিয়েছে পাথরের ধস। আমাদের জন্যে সুবিধেই। আশা করি উঠতে পারব ওখানে, প্রথম হলুদ পাথরটা দেখল সে।
এ পাথরের খাঁজে খাঁজে হাত-পায়ের আঙুল বাধিয়ে উঠতে শুরু করল মিঙ। তাকে অনুসরণ করল রবিন। তার নিচে মুসা। এসব ব্যাপারে সে ওস্তাদ। নিজে তো উঠছেই, মাঝেমধ্যে নিচ থেকে ঠেলে উঠতে সাহায্য করছে রবিনকেও। দুই মিনিটেই উঠে এল ওরা হলুদ পাথরের কাছে। তাজ্জব হয়ে দেখল দুই গোয়েন্দা, দুটো পাথরের মাঝে একটা বড় ফোকর। দ্বিতীয় পাথরটা আসলে ছাত সৃষ্টি করে রেখেছে গর্তের মুখে, বেশির ভাগটাই পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে প্রায় ঝুলে রয়েছে শূন্যে।
গুহা, বলল মিঙ। অনেক বছর আগে এক খনি-শ্রমিক স্বর্ণের লোভে খুঁজতে শুরু করে একাই। সুড়ঙ্গ কেটে ঢুকে যায় ভেতরে। ওখানেই ঢুকব আমরা।
সুড়ঙ্গে নেমে গেল মিঙ। পেছনে নামল রবিন আর মুসা। গাঢ় অন্ধকারে এগিয়ে চলল অন্ধের মত। কিছুই জানে না কোথায় যাচ্ছে, কি আছে সামনে।
দশ
গুহার শেষ প্রান্তে নিয়ে এল দুজনকে মিঙ। টর্চের আলোয় দেখা গেল বেশ বড় গুহা। এক জায়গায় একটা সুড়ঙ্গমুখ, আসলে পুরানো খনির গ্যালারি, বহু বছর আগে খোঁড়া হয়েছিল। জায়গায় জায়গায় এখনও ছাত ঠেকা দিয়ে রেখেছে পুরানো। কাঠের থাম, তবুও বেশ কিছু পাথর খসে পড়েছে ছাত থেকে।
আমার প্ল্যান শোনো, বলল মিঙ। আরও অনেক গ্যালারি আছে এই পাহাড়ের নিচে। প্রথম যখন এসেছিলাম, দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। এক বুড়ো আছে, ন্যাট বারুচ, এখানকার প্রতিটি ইঞ্চি চেনা তার। সারাটা জীবন এসব খনিতেই কাটিয়েছে, সোনা খুঁজেছে, মাঝে মাঝেই পেয়েছে ছোটখাটো টুকরো।
বুড়ো এখন হাসপাতালে। বারুচই চিনিয়েছে আমাকে খনিগুলো। এই গুহা থেকে একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে একেবারে সেই গুহাটায়, যেখানে মদ চোলাই করা হয়। যেটাতে বসে খেয়েছি আমরা খানিক আগে।
সেরেছে! তাই নাকি? চেঁচিয়ে উঠল মুসা। গুহার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে বেশি করে কানে বাজল সে আওয়াজ। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ফেলল সে। তারমানে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা? বাহ, কি মজা। ওপরে আমাদেরকে খুঁজছে মরিসন, ঘুণাক্ষরেও ভাবছে না আমরা তার নিচেই রয়েছি।
ঠিক তাই, সায় দিল মিঙ। এভাবেই বাড়ির মাইলখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাব আমরা, ওদের অলক্ষ্যে। গুহামুখে পাহারা রাখার কথা ভাববে না ওরা, সুযোগটা নেব আমরা। ওখান দিয়ে বেরিয়ে এক দৌড়ে বাড়ি চলে যাব। তারপর আর ঠেকায় কে? দেব মরিসনের কীর্তি ফাঁস করে।
মুক্তির কথা ভেবে আনন্দিত হলো রবিন, কিন্তু অন্ধকার সুড়ঙ্গ ধরে এতখানি যেতে হবে ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। যদি আটকে যায়? যদি পাথর পড়ে সামনের পথ বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে? কিংবা যদি পথ হারায় মিঙ? তাহলে হয়তো আর কোন দিনই বেরোতে পারবে না মাটির তলার এই গোলকধাঁধা থেকে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে সবুজ চকের অস্তিত্ব অনুভব করল সে।
চিহ্ন রেখে যাব নাকি? বলল রবিন। তাহলে পথ হারালেও চিহ্ন দেখে আবার ফিরে আসতে পারব।
হারাব না, দৃঢ়কণ্ঠে বলল, মিঙ। যদি মরিসন এসে ঢোকে এখানে? চিহ্ন দেখে সব বুঝে গিয়ে আমাদের পিছু নেয়? না, ওসবের দরকার নেই।
নিজের ওপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস মিঙের। কিন্তু রবিন জানে, মানুষ যা আশা করে না, তাই ঘটে যায় অনেক সময়।
মুসা রবিনের সঙ্গে একমত। বলল, আমরা এমন চিহ্ন রেখে যাব খেয়ালই করবে না মরিসন। দেয়ালে চক দিয়ে আশ্চর্যবোধক একে দেব, মাঝে মাঝে তীরচিহ্ন আঁকব, একেকবার একেক দিকে মুখ করে, কেউ বুঝবেই না আমরা কোন দিকে গেছি। আশ্চর্যবোধকগুলোকে গুরুত্ব দেবে না, তীরচিহ্ন ধরে একবার এদিক যাবে, একবার ওদিক, ঘুরে মরবে শুধু শুধু।
তা করা যেতে পারে, মাথা দোলাল মিঙ। তবে এত ভাবনার কিছু নেই। এদিককার খনিগুলো চেনে না মরিসন, জানে না মদ চোলাইয়ের গুহাটার সঙ্গে যে এই গুহার যোগাযোগ আছে। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, হুঁশিয়ার থাকা ভাল। বলা তো যায়, যদি হারিয়ে যাই? তবে এই সুড়ঙ্গের মুখে চিহ্ন দেয়া চলবে না, তাহলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হবে কোন্টাতে ঢুকেছি আমরা। ভেতরে ঢুকে তারপর চিহ্ন দেয়া শুরু করব।