এত রাগল কেন মরিসন, তাই ভাবছি, বলতে বলতে পঁাচ ঘুরিয়ে টর্চের পেছনের ক্যাপ খুলে ফেলল মিঙ। ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে বের করে আনল তুলট কাগজের ছোট একটা প্যাকেট। হাতের তালুতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। খুলল সাবধানে।
গোস্ট পার্লস! ভেতরের জিনিসটা দেখে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
মরিসন চুরি করেছিল! রবিনও চেঁচাল।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল মিঙের। তাই তো মনে হচ্ছে। টর্চের ভেতর। বাহ, চমৎকার বুদ্ধি। পুরানো যন্ত্রপাতির বাক্সে বাতিল টর্চ, কেউ সন্দেহ করবে না। জীপের ভেতর নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কাছছাড়া করার ঝুঁকি নেয়নি।
হুঁ, ভাল জায়গায়ই লুকিয়েছিল, বলল রবিন। আমাদের হঠাৎ টর্চের দরকার হবে, কল্পনাও করেনি।
ভাবছি, প্রেসিং হাউসে লোকগুলোকে নিয়ে কি করছিল? মিঙের কণ্ঠে অস্বস্তি।
এখন তো অনেক কিছুই সন্দেহ হচ্ছে। এই যে একের পর এক দুর্ঘটনা, পিপা ফুটো হওয়া, মেশিন ভেঙে যাওয়া, এসবে তার কোন হাত নেই তো?
থাকতেও পারে। চলো, তোমার দাদীমাকে গিয়ে সব খুলে বলি। শেরিফকে ডেকে এনে মরিসনকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন।
যত সহজ ভাবছ তত সহজ হবে না, ধীরে ধীরে বলল মিঙ। মরিসন ডেনজারাস লোক। মরিয়া হয়ে উঠলে কি করবে বলা যায় না। আমাদের এখন বাড়ি ফিরতে দিলে হয়।
কি করবে? উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল রবিন।
সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে বলল মিঙ, দেখা যাক কি করে? রবিন, তুমি ঘোড়াগুলো রাখো। আমি আর মুসা গিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসি, নিচে কি হচ্ছে।
তিনটে রাশ হাতে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে বসে রইল রবিন।
মিঙ আর মুসা ফিরে চলল, যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে।
সমতল জায়গাটার কিনারে এসে ঝুঁকে নিচে তাকাল। পথের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক, পাহারায় রয়েছে যেন। আঁকি খেতে খেতে গায়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে জীপটা। প্রেসিং হাউসের কাছে দাঁড়ানো দুটো পুরানো গাড়ি স্টার্ট নিয়ে এগিয়ে এল খেতের ওপর দিয়ে, পাহাড়ী পথটাই বোধহয় লক্ষ্য।
সরু পাহাড়ী পথের কয়েকগজ ওপরে এসে থেমে দাঁড়াল আগের গাড়িটা, পেছনেরটা আড়াআড়িভাবে থামল পথের ঠিক গোড়ায়। উদ্দেশ্য বোঝা গেল, পথ রোধ করেছে। ঘোড়া নিয়ে গাড়ি দুটোকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, যেতে হলে। ডিঙিয়ে যেতে হবে, এবং সেটা সম্ভব নয়-আর কোন উপায় নেই!
দম আটকে আসছে যেন মিঙের। নিচু গলায় বলল, ঘোড়ার জন্যে গেছে। মরিসন। আমরা যাতে পালাতে না পারি, সেজন্যে লোকগুলোকে রেখে গেছে।
তারমানে ফাঁদে ফেলেছে?
তাছাড়া আর কি? ওপথে ফিরে যেতে পারব না আমরা, এগিয়ে গিয়ে উল্টো পাশে হয়তো নামতে পারব, কিন্তু সহজ হবে না। নিচে হ্যাঁশনাইফ ক্যানিয়ন, গভীর একটা গিরিসঙ্কট, তা-ও বক্স ক্যানিয়ন। এক দিক রুদ্ধ, আরেক দিক খোলা। খোলা, দিক দিয়ে বেরোলে সরু একটা পথ পাওয়া যাবে, খুব খারাপ পথ, উঁচুনিচু, স্যান ফ্রানসিসকো যাওয়ার মেইন রোডের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে।
কিন্তু ওপথ ধরে গেলেও বাঁচতে পারব না। সহজেই ধরে ফেলবে আমাদেরকে মরিসন। ইতিমধ্যেও ওই পথের শেষ মাথায় পাহারা পাঠিয়ে দিয়েছে কিনা কে জানে। নেকলেসটা ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠবে সে, জানা কথা।
কিন্তু এসব করে পার পাবে না, চেপে রাখা দম ফেলল মুসা। নেকলেসটা। নিয়ে নেবে, কিন্তু আমরা তো বলে দেব।
ওকথা ভাববে না মনে করেছ? মিঙের অস্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠ ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দিল মুসার শিরদাঁড়ায়। আমাদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করবে। যারা যারা এখানে দেখেছে আমাদের, সব মরিসনের লোক, কেউ মুখ খুলবে না।
চুপ হয়ে গেল মুসা। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ঢোক গিলল।
এসো, মুসার হাত ধরে টানল মিঙ। হঠাৎ হাসি ফুটল মুখে, কালো চোখের তারা উজ্জ্বল। একটা ফন্দি এসেছে মাথায়। গাঁয়ে গিয়ে ঘোড়া নিয়ে ফিরতে মরিসনের সময় লাগবে। ওকে ফাঁকি দেব আমরা। জলদি করতে হবে। চলো।
দৌড়ে ফিরে এল ওরা। অধৈর্য হয়ে উঠেছে রবিন। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বলল, কি ব্যাপার?
ফাঁদে আটকেছে আমাদের, জানাল মুসা। নেকলেসটা ফেরত চায় মরিসন, সেইসাথে আমাদের মুখ বন্ধ করে দিতে চায়। লোকগুলো ওর সহকারী।
কিন্তু ওকে বোকা বানাব আমরা, আশ্বাস দিল মিঙ। পাহাড়ের চূড়া লম্বালম্বি এগিয়ে গেছে, চূড়ার ওপর দিয়েই বক্স ক্যানিয়নের পাশ কেটে চলে যাব, তারপর নামব। আরেকটা গিরিপথ আছে।
ঘোড়ায় চাপল আবার তিনজনে। আস্তে আস্তে চলল মিঙ, ঘোড়াগুলোকে ক্লান্ত করতে চায় না। তার পেছনে রইল রবিন, সবার পেছনে মুসা। তরুণ কোল্টের কোনরকম আড়ষ্টতা নেই, স্বচ্ছন্দে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু নড়বড়ে বুড়িটার নড়ার ইচ্ছে নেই, খালি, দাঁড়িয়ে পড়তে চাইছে! মুসার তরুণীর মেজাজ মর্জিও বিশেষ সুবিধের নয়। যে-কোন মুহূর্তে অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তবু বাধ্য হয়ে ওগুলোতে চড়েই এগোতে হলো ওদের, যা পথ, পায়ে হাঁটা সম্ভব না।
যা-ই হোক, নিরাপদেই আধ ঘণ্টা পর পাথুরে গিরিপথে এসে নামল ওরা।
হ্যাশনাইফ ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে ওদিকে গেছে পথটা, হাত তুলে দেখাল। মিঙ। মরিসনের ধারণা ওই পথ ধরে গিয়ে হাইওয়েতে উঠব আমরা। আসলে করব উল্টোটা। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিল সে, চলতে শুরু করল সঙ্কীর্ণ গিরিপথ ধরে। দুপাশে পাহাড়ের খাড়া দেয়াল। মাথার ওপরে আকাশের একটা অংশ শুধু দেখা যায়।