হলের এক জায়গা থেকে উঠে গেছে সুদৃশ্য সিঁড়ি, তাতে আলো ফেলল। একজন।
ওটা থেকে পড়েই বোধহয় পঞ্চাশ বছর আগে ঘাড় ভেঙেছিল চীনা বুড়ো ফারকোপার কৌন, বলল যে লোকটা সিঁড়িতে আলো ফেলেছে সে।
উহ্, গন্ধ! পঞ্চাশ বছরে ঘর খোলেনি নাকি কেউ?
কে খুলতে যাবে ভূতের বাড়ি? বলল আরেকজন। এমন জায়গা, ভূত থাকা। বিচিত্র নয়। এসে এখন দেখা না দিলেই বাঁচি।
যত্তোসব বাজে বকবকানি, বিড়বিড় করল নেতা। আসুন, নিচতলা থেকেই খুঁজতে শুরু করি।
বড় বড় একেকটা ঘর। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হতে লাগল। আসবাবপত্র নেই, মেঝেতে পুরু ধুলো। এক প্রান্তে ঘরে পেছনের দেয়াল অনেকখানি নেই, ওখান থেকেই ভাঙা শুরু করেছে শ্রমিকেরা।
কোন ঘরেই কিছু পাওয়া গেল না। শূন্য বাড়ি। কথা বললেই প্রতিধ্বনি উঠছে, ফলে জোরে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে সবাই, ফিসফিস করে বলছে। এ প্রান্তে কিছু নেই, বাড়ির অন্য প্রান্তের দিকে চলল ওরা। বড়সড় একটা পারলারে চলে এল। এক প্রান্তে বড় ফায়ারপ্লেস, আরেক প্রান্তে উঁচু জানালা। গুটি গুটি পায়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে এসে দাঁড়াল লোকেরা, অস্বস্তি বাড়ছে।
আমাদের দিয়ে হবে না, নিচু কণ্ঠে বলল, একজন। পুলিশ…
শ্শ্শ্! হুঁশিয়ার করল আরেকজন, বরফের মত জমে গেল যেন সবাই। শব্দ
হঁদুর-টিদুর, ফিসফিস করে বলল তৃতীয় আরেকজন। আলো নেভান। অন্ধকারে নড়ে কিনা দেখি।
নিভে গেল সব কটা টর্চ। ঘন কালো অন্ধকার গিলে নিল যেন মানুষগুলোকে। ধুলোয় ঢাকা ময়লা কাঁচের শার্সি দিয়ে চাঁদের আলো আসছে এত স্নানভাবে, অন্ধকার একটুও কাটছে না।
দেখুন! বলে উঠল একজন, গলা টিপে ধরা হয়েছে যেন তার। দরজার কাছে!
একসঙ্গে ঘুরল সবাই। দেখল।
যে দরজা দিয়ে ওরা ঢুকেছে, ওটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক সবুজ মূর্তি। শরীর থেকে আবছা দ্যুতি বেরোচ্ছে, কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। রবিনের মনে হলো দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। ওটা কি? লম্বা একজন মানুষই তো, নাকি? গায়ে সবুজ ঢোলা আলখেল্লা?
ভূত! শোনা গেল দুর্বল কণ্ঠে চিৎকার। বুড়ো ফারকোপার কৌন!
আলো! চেঁচিয়ে আদেশ দিল বিশালদেহী লোকটা। টর্চ জ্বালুন।
আলো জ্বালার আগেই নড়তে শুরু করল সবুজ মূর্তিটা। দেয়ালের ধার ধরে যেন বাতাসে ভেসে চলল, বেরিয়ে গেল খোলা দরজা দিয়ে। তিনটে আলোর রশ্মি ছুটে গেল মূর্তিটার দিকে, চোখের পলকে নেই হয়ে গেল ওটা।
আমি মরে গেছি, দোজখে আছি এখন! রবিনের কানে কানে বলল মুসা। ওটা দোজখের দারোয়ান।
গাড়ির আলো হতে পারে, নিস্তেজ কণ্ঠে বলল একজন। জানালা দিয়ে এসেছে। চলুন তো, ওপাশের ঘরে গিয়ে দেখি।
দল বেঁধে এসে ঢুকল সবাই পাশের বড় ঘরে, আরেকটা হলরুম। আলো ঘুরিয়ে দেখল। কিছু নেই। আলো নেভানোর পরামর্শ দিল একজন, তাহলে ভূতটা আবার আসতে পারে।
অন্ধকারে অপেক্ষা করে আছে ওরা। চাপা গোঁ গোঁ করছে ছোট্ট কুকুরটা।
এইবার মুসা দেখল সবার আগে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সবাই। মুসাও তাকাচ্ছে, হঠাৎ চোখ পড়ল সিঁড়ির দিকে।
ওই যে! আল্লাহ রে, খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল সে। সিঁড়িতে!
সবাই দেখল। সিঁড়ির ধাপগুলোর ওপর দিয়ে যেন বাতাসে ভেসে উঠে গেল মূর্তিটা দোতলায়।
ধরো! বলে উঠল বিশালদেহী লোকটা। বোকা বানাচ্ছে আমাদের। ধরো ব্যাটাকে।
দুপদাপ করে উঠতে শুরু করল সবাই। দোতলায় কেউ নেই। সবুজ মূর্তি গায়েব।
হুমম, একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়, কিশোরের ভঙ্গি নকল করে বলল রবিন। ঘুরে একজন আলো ফেলল তার মুখে। সবাই ফিরে তাকাল। এক কাজ করতে পারি। যে রকম ধুলো, নিশ্চয়ই পায়ের ছাপ ফেলেছে। ওই ছাপ অনুসরণ করে ধরে ফেলতে পারব ব্যাটাকে। আমরা এখনও ওদিকে যাইনি, ছাপ পড়লে শুধু ওটারই পড়বে।
ঠিক বলেছে, ছেলেটা, সায় দিল কুকুরের মালিক। আলো ফেলুন। আলো ফেলে দেখুন।
প্রচুর ধুলো আছে, কিন্তু তাতে পায়ের ছাপ নেই, অথচ ওদিকেই গেছে মূর্তিটা, স্পষ্ট দেখেছে সবাই।
নেই! বলল কুকুরের মালিক। অদ্ভুত কাণ্ড! কি দেখলাম তাহলে? কেউ জবাব দিল না। সবাই ভাবছে। প্রত্যেকে যেন পড়তে পারছে প্রত্যেকের মনের কথা।
আবার আলো নিভিয়ে দেখা যাক তো, বলল আগের বার যে পরামর্শ দিয়েছিল সে।
চলুন কাটি এখান থেকে, বলল আরেকজন, কিন্তু তার কথা ঢাকা পড়ে গেল অন্যদের সমর্থনে। হা হা, আলো নিভিয়ে দেখা যাক।
ভয় পাচ্ছে ঠিক, কিন্তু সেটা দেখাতে চাইছে না অনেকেই।
আলো নিভে গেল। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সবাই। নিচে হলের দিকে চেয়ে আছে রবিন আর মুসা, এই সময় বলে উঠল কেউ, ওই, ওই যে। বাঁয়ে।
একটা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষেরই আকার, সবুজ, স্পষ্ট হয়েছে। আরও। মনে হচ্ছে যেন বুড়ো ফারকোপারই সবুজ আলখেল্লা পরে দাঁড়িয়ে আছে।
ভয় পাবেন না, ফিসফিস করে বলল কেউ। দেখি কি করে।
নীরবে অপেক্ষা করে রইল দর্শকরা।
নড়তে শুরু করল মূর্তিটা। হলের দেয়ালের ধার ঘেঁষে আস্তে আস্তে ভেসে গেল। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কোণের কাছে গিয়ে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।
চলুন, দেখি কোথায় গেল? বিড়বিড় করল এক দর্শক। পালানোর তো চেষ্টা করে না।
এবার ছাপ দেখা যাক, বলে উঠল রবিন। ওই দেয়ালের কাছে কেউ যায়নি। দেখি, পায়ের ছাপ আছে কিনা।
সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল দুটো টর্চ। দেয়ালের নিচের মেঝেতে ফেলল আলো।