ঘোড়ায় চড়ে চষা খেতের ওপর দিয়ে চলল মুসা। দুই মিনিটেই পৌঁছে গেল জীপের কাছে। খেয়েদেয়ে আর বিশ্রাম নিয়ে আবার তাজা হয়ে উঠেছে ঘোটকী, চঞ্চলতা বেড়েছে, সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে মুসার। নেমে রাশ ধরে রাখল শক্ত হাতে। আরেক হাতে খুলল জীপে রাখা টুলবক্সের ডালা। টর্চটা দেখা যাচ্ছে না। কয়েকটা যন্ত্রপাতি সরাতেই পাওয়া গেল ওটা, বাক্সের এক কোণে লুকিয়ে ছিল। তুলে নিল। পুরানো ধাচের বড় ভারি জিনিস, কালো প্লাস্টিকের খোল, পেছনে। রিঙ বা লুপ জাতীয় কিছু নেই কোমরে ঝোলানোর জন্যে, অগত্যা কোমরের বেল্টের ভেতর গুঁজে রাখল সেটা।
নোটটা বাক্সে রাখল, ডালা তোলাই রইল, যাতে এসে প্রথমেই কাগজটা চোখে পড়ে মরিসনের। অনেক কায়দা-কসরত করতে হলো ঘোড়ায় চড়তে, কিছুতেই পিঠে নিতে চাইছে না ঘোটকী।
বড় জোর একশো গজ এসেছে, এই সময় পেছনে চিৎকার শুনতে পেল মুসা। ফিরে তাকাল। জীপের কাছে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাত নাড়ছে মরিসন, চেঁচামেচি করছে। টর্চটা দেখাল মুসা, ইঙ্গিত বোঝাতে চাইল নোট রয়েছে টুলবক্সে, ঘোড়া থামাল না।
লাফিয়ে জীপে উঠল মরিসন। চিৎকার শুনে প্রেসিং হাউস থেকে অন্য লোকগুলো বেরিয়ে এসেছে, দেখছে। আঙুরের ঝোঁপ দলে খেত মাড়িয়েই ছুটে আসতে লাগল জীপ। দরজা দিয়ে মুখ বের করে চিৎকার করছে ফোরম্যান, হাত নেড়ে থামার ইঙ্গিত করছে মুসাকে।
থামতে চাইছে মুসা, কিন্তু ঘোটকী কথা শুনছে না। চেঁচামেচিতে অস্বস্তি বোধ করছে বোধহয়। আরে থাম থাম! রাশ টেনে ধরল সে।
কাছে এসে থামল জীপ। খানিকটা পাশে সরে গেল ঘোটকী। বন্দুকের নল থেকে গুলির মত ছিটকে বেরিয়ে দৌড়ে এল মরিসন। চোর! চোর কোথাকার! ছাল ছাড়াব… রাগে বাক্য শেষ করতে পারল না, মুখে আটকে গেল।
ঘোটকী বোধহয় ভাবল, তাকেই গাল দিচ্ছে লোকটা, মারতে আসছে, আকাশমুখী বিরাট এক লাফ মারল। আরেকটু হলেই পড়ে গিয়েছিল মুসা, খপ করে চেপে ধরল জিনের সামনের উঁচু শক্ত মাথাটা।
আবার চেঁচিয়ে উঠল মরিসন।
ঘাবড়ে গিয়ে ছুট লাগাল ঘোটকী, আঙুরের ঝোঁপ দলে দৌড় দিল পাহাড়ের ঢালের দিকে, অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারল না মুসা। কি আর করবে? দুহাঁটু ঘোড়ার পেটের সঙ্গে চেপে রেখে, জিন আর রাশ একই সঙ্গে আঁকড়ে ধরে কোনমতে জানোয়ারটার পিঠে উপুড় হয়ে রইল সে।
নয়
দূর থেকেই দেখতে পেল মুসা, পাহাড়ের ঢালে সরু একটা পথ উঠে গেছে, বেশ খাড়া। সোজা সেই পথে এসে উঠল ঘোটকী। গতি সামান্য কমল, এই সুযোগে আরেকটু শক্ত হয়ে বসল মুসা। পড়ে যাওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে ফিরে তাকাল একবার। জীপ নিয়ে তাড়া করে আসছে মরিসন। উঁচুনিচু খেতের ওপর দিয়ে সাংঘাতিক ঝাঁকি খেতে খেতে আসছে গাড়ি।
পাহাড়ী পথের গোড়ায় এসে থেমে গেল জীপ। লাফিয়ে নামল মরিসন, ঘুসি পাকিয়ে হাত কঁকাতে লাগল মুসার দিকে।
রবিন আর মিঙকে বেরোতে দেখল মুসা। ঘোড়ায় চড়ল ওরা তাড়াহুড়ো করে, মুসার দিকে ছুটে আসতে শুরু করল। মরিসন আর তার জীপের পাশ কাটিয়ে ছুটে এল দ্রুত গতিতে, মিঙ আগে, রবিন পেছনে। সাংঘাতিক জোরে ছুটছে মিঙের কালো কোল্ট, মুসার ঘোটকীর সঙ্গে দূরত্ব কমছে।
একটা পাথরের পাশ কাটাতে গিয়ে জোরে মোচড় খেলো ঘোটকীর শরীর, কোনমতে দ্বিতীয়বার পতন রোধ করল মুসা। একটা মোটামুটি সমতল জায়গায় এসে আবার গতি বাড়াল ঘোড়া। পেছনে খুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে। খানিক পরেই মুসার পাশাপাশি হলো মিঙ। ঘোটকীর রাশ ছেড়ে দিয়েছে মুসা, বাতাসে উড়ছে ওটা, হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল মিঙ। কোল্টের গতি কমাল ধীরে ধীরে, টানের চোটে ঘোটকীও গতি কমাতে বাধ্য হলো। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়ল দুটো ঘোড়া, নাক প্রসারিত, জোরে জোরে শ্বাস টানছে, চামড়া ঘামে ভেজা।
ধন্যবাদ, মিঙ, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মুসা। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম, পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে বুঝি ঘোটকীর বাচ্চা।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে মুসার দিকে চেয়ে আছে মিঙ।
কি ব্যাপার? অমন করে দেখছ কেন?
ভাবছি, মিঙ বলল, তোমার ঘোড়াকে তাড়া করল কেন মরিসন?
কি জানি! চেঁচামেচি শুরু করে দিল। চোর বলে গাল দিল। ভীষণ রেগেছে।
আসার সময় দেখলাম, ইবলিসের চেহারা হয়ে গেছে। রাগে হাত-পা ছুঁড়ছে। পকেটে রিভলভার আছে, র্যাটল সাপ মারার জন্যে দিয়েছে দাদীমা, ওটা প্রায় বের করে ফেলেছিল।
বুঝতে পারছি না, মাথা চুলকাল মুসা। পুরানো একটা টর্চের জন্যে এই কাণ্ড কেন করল? বেল্টে গোঁজা কালো জিনিসটা টেনে খুলে দেখল।
টর্চটার দিকে তাকিয়ে রইল মিঙ। ওটা…ওটা মরিসনের টর্চ নয়, চেঁচিয়ে উঠল সে। মানে, টুলবক্সে কখনও দেখিনি এটা। গতরাতে আরেকটা দিয়েছিল।
আমি এটাই পেয়েছি। আর কোন টর্চ দেখিনি। তুমি বললে বলেই নিলাম…ও এমন আচরণ করবে জানলে…
ভুলই করেছি, বাধা দিয়ে বলল মিঙ। দেখি? হাত বাড়াল সে।
টর্চটা দিল মুসা। হাতে নিয়ে দেখল মিঙ, ওজন আন্দাজ করল। হালকা। ভেতরে বোধহয় ব্যাটারি নেই।
তাহলে তো কোন কাজে আসছে না, দারুণ বিরক্ত শোনাল মুসার কণ্ঠ। এমন একটা জিনিসের জন্যে এই কাণ্ড করল মরিসন? কেন?
হয়তো… রবিনকে দেখে থেমে গেল মিঙ।
টলোমলো পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল রবিনের নড়বড়ে বুড়ো ঘোড়া। ফেস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে, ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন হাঁপাচ্ছে রবিন। উফ বেঁচেছি। আরেকটু হলেই গেছিলাম। একবার তো মনে হলো, হাঁটু ভেঙে আমাকে নিয়েই গড়িয়ে পড়বে ঘোড়া।…কি ব্যাপার? কিছু হয়েছে?