পাশে এসে থেমে গেল জীপ। মুখ বাড়াল ফোরম্যান মরিসন। হেই, মিঙ, অবস্থা তো খুব খারাপ। শ্রমিক নেই, দেখেছ?
মাথা কেঁকাল মিঙ।
ওই তিন শয়তানের কাণ্ড, বলল মরিসন, ধসিয়ে দিয়েই ছাড়ল শেষকালে। লোক জোগাড়ের অনেক চেষ্টা করছি, হচ্ছে না। কেউ আসতে রাজি না।
চুপ করে রইল মিঙ।
মিস কৌনকে জানাতে যাচ্ছি। গতিক সুবিধের না।
জোর করে নিজের বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলল মিঙ। যাকগে, যা হওয়ার হবে। ভাগ্যের ওপর তো কারও হাত নেই। চলো, আমাদের কাজ আমরা করি।
পুরো উপত্যকায় ঘুরে বেড়াল ওরা। মাঝেমধ্যে থেমে এটা-ওটা দেখল। প্রেসিং হাউসগুলো সব দেখাল মিঙ। দুপুরের দিকে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওরা, খিদেও লেগেছে খুব। সঙ্গে স্যাণ্ডউইচ আর ক্যান্টিনে পানি নিয়ে এসেছে, ব্যাগে করে এনেছে ঘোড়ার খাবার।
ঠাণ্ডা একটা জায়গা আছে, জানাল মিঙ, আরামে বসে খাওয়া যাবে। পুরানো একটা বিল্ডিঙের ধার দিয়ে নিয়ে চলল সে দুই গোয়েন্দাকে, পুরানো প্রেসিং হাউস, পরিত্যক্তই বলা চলে, খুব বেশি চাপ না থাকলে এখানে কাজ চলে না আজকাল।
আরও একশো গজ এগিয়ে, পশ্চিমের পাহাড়শ্রেণীর গোড়ায় ছায়া পাওয়া গেল। ঘোড়াগুলোকে ছায়ায় বেঁধে খেতে দেয়া হলো।
পর্বতের গা থেকে ছোট্ট একটা শাখা বেরিয়েছে ওখানে, শাখার গায়ে ঢাল কেটে ভারি একটা দরজা বসানো হয়েছে। দুই গোয়েন্দাকে দরজার সামনে নিয়ে। এল মিঙ। এটাই সেই গুহা, যেটার কথা বলেছিলাম। জোরে টান দিয়ে দরজাটা খুলল সে। ভেতরে অন্ধকার। আগে খেয়ে নিই, তারপর দেখাব সব কিছু।
দরজার পাশে বসানো সুইচ বোর্ড, সুইচ টিপে দিল মিঙ। ক্লিক করে শব্দ হলো কিন্তু আলো জ্বলল না। ওহহো, ভুলেই গিয়েছিলাম, ডায়নামো বন্ধ। কাজ না চললে বন্ধই রাখা হয়। টর্চ জ্বালতে হবে।
কোমরে ঝোলানো টর্চ খুলে নিয়ে জ্বালল মিঙ। লম্বা একটা করিডর দেখা গেল, দুধারে পাথরের দেয়াল, ছাত যাতে ভেঙে না পড়ে সেজন্যে কাঠের মোটা মোটা কড়িবর্গা লাগানো হয়েছে, দুই দিকেরই দেয়াল ঘেঁষে সারি দিয়ে রাখা হয়েছে রাশি রাশি জালা। করিডরের ঠিক মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সরু লাইন, খানিক দূরে লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটা ফ্ল্যাটকার।
মদের জালা ফ্ল্যাটকারে তুলে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয় দরজার কাছে, বুঝিয়ে বলল মিঙ। লাইনের শেষ মাথায় ট্রাক দাঁড়ায়, তাতে বোঝাই করা হয় জালা। লাইনের ওপর দিয়ে ফ্ল্যাটকার ঠেলে আনা খুবই সহজ, পরিশ্রম খুবই কম হয়, যত ভারি বোঝাই থাকুক না কেন।
বুঝলাম, হাত তুলল মুসা। কথা আর না বাড়িয়ে আগে পেট ঠাণ্ডা করে নিলে কেমন হয়?
পাথরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল মুসা আর রবিন, মিঙ বসল তাদের মুখোমুখি। লাঞ্চ প্যাকেট খুলল। মাত্র কয়েক ফুট দূরে, দরজার বাইরে অপরাষ্ট্রের কড়া রোদ, তীব্র; গরম, অথচ গুহার ভেতরে এখানে বেশ ঠাণ্ডা, যেন এয়ারকুলার লাগানো রয়েছে।
খেতে খেতেই মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে ওরা, পুরানো প্রেসিং হাউসটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, কিন্তু ওখান থেকে কেউ দেখতে পাবে না ওদেরকে।
খাওয়া শেষ। হাত-পা ছড়িয়ে আরামে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে ওরা। নিজের জীবনের কথা বলছে মিঙ। কয়েকটা পুরানো গাড়ি এসে থামল পুরানো প্রেসিং হাউসের কয়েকশো গজ দূরে, নতুন প্রেসিং হাউসের সামনে।
জনা ছয়েক লোক নামল গাড়ি থেকে, সব কজনের বিশাল শরীর, শক্তিশালী। এক জায়গায় জমা হলো ওরা। কোন কিছুর অপেক্ষা করছে মনে হচ্ছে।
চুপ হয়ে গেছে মিঙ। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেন? এমনিতেই লোক কম, আঙুর তোলা শুরু করছে না কেন?
মরিসনের জীপ এসে থামল লোকগুলোর পাশে, লাফ দিয়ে নামল বিশালদেহী ফোরম্যান। প্রেসিং হাউসের দিকে চলল, তাকে অনুসরণ করল ছয়জন। সবাই ঢোকার পর দরজা বন্ধ করে দিল।
মেশিন চালাবে বোধহয়, বিড়বিড় করল মিঙ। তার ব্যাপার, যা খুশি কর.গে। লোকটাকে পছন্দ করি না, কিন্তু কাজ বোঝে। শ্রমিক সামলাতে তার জুড়ি কম। দুর্ব্যবহারও করে। কনুইয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে আছে সে, রবিন আর মুসার দিকে তাকাল। খনির সুড়ঙ-টুড়ঙ দেখার ইচ্ছে আছে?
আছে, জানাল দুই গোয়েন্দা। কোমরের বেল্টে ঝোলানো টর্চ খুলে নিল। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আলগা পাথরে পা পিছলাল মুসা, পতন ঠেকাতে গিয়ে হাত থেকে ছুটে গেল টর্চ, পাথুরে মেঝেতে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলল।
টর্চটা কুড়িয়ে নিয়ে রবিনের টর্চের আলোয় দেখল, কাঁচ আর বা ভেঙে গেছে! ইয়াল্লা। গেছে আমার টর্চ।
দুটোতেই চলবে, বলল মিঙ, তবে… প্রেসিং হাউসের কাছে দাঁড়ানো জীপটার দিকে তাকাল, তবে, ইচ্ছে করলে মরিসনের টর্চটা নিতে পারি। গতরাতে যেটা ধার দিয়েছিল আমাকে। তার টুলবক্সে অন্যান্য যন্ত্রপাতির সঙ্গে রাখে। রাতের আগে ফেরত দিলেই চলবে। তোমরা থাকো, আমি গিয়ে নিয়ে আসি।
বাধা দিয়ে মুসা বলল, তুমি থাকো, আমিই যাই। আমি ভেঙেছি, আনার দায়িত্ব আমার।
কি ভাবল মিঙ, মাথা কাত করল, ঠিক আছে। নোটবুক বের করে পাতা ছিঁড়ে তাতে নোট লিখল মরিসনকে, টর্চটা ধার নিচ্ছি। রাতের আগে ফেরত দেব।-মিঙ। কাগজটা মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল। কাজের সময় বিরক্ত করা পছন্দ করে না সে। এই নোটটা টুলবক্সে রেখে এসো। যন্ত্রপাতি সব কোম্পানির, আমি লিখে দিয়েছি, কিছু মনে করার নেই তার।