বোধহয় না। কি বোঝাতে চাইছ?
উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠল কিশোরের মুখ। চিৎকারটা সবাই শুনেছে, পিটারসনের ছোট কুকুরটাও। হয়তো কোন সূত্র দিতে পারবে ওটা। শার্লক হোমসকে অনেক সময় অনেকভাবে সাহায্য করেছে কুকুর।
তাড়াহুড়ো করে নিজের ঘরে চলে এল কিশোর। খুলতে শুরু করেছে কয়েকটা প্যাঁচ।
কৌন ম্যানশনে দরজা বন্ধ ঘরে চিৎকার করেছিল সে, তার চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পায়নি পুলিশম্যান। কিন্তু বাইরে এসে ঝোঁপের ভেতর থেকে যখন চিৎকার করল, স্পষ্ট শুনতে পেল। এটা একটা জোরাল পয়েন্ট।
টেপরেকর্ডার বের করে রবিনের রেকর্ড করে আনা ক্যাসেটটা চালু করে দিল। মন দিয়ে শুনল চিৎকার, কথাবার্তা আর যতরকম আওয়াজ শোনা গেল সব। তারপর চুপচাপ ভাবল কয়েক মিনিট। সেদিন রবিন যা যা বলেছে, আবার পর্যালোচনা করে দেখল মনে মনে। যাচ্ছে, খাপে খাপে বসে যাচ্ছে! কিন্তু অনেকগুলো ব্যাপার এখনও অস্পষ্ট, কিংবা দুর্বোধ্য।
ঘর অন্ধকার। আলো জ্বালার দরকার মনে করল না কিশোর, হঠাৎ উঠে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল শুরু করল। অনেকক্ষণ পর ওপাশে ফোন তুলল। কেউ।
হ্যালো, রবিনকে দেয়া যাবে? অনুরোধ করল কিশোর।
কে, কিশোর পাশা? মিস দিনারা কৌনের কণ্ঠ, কাঁপছে।
হ্যাঁ। রবিনকে দরকার, মিস কৌন। কয়েকটা জরুরী কথা…
..রবিন তো নেই।
নেই?
নেই, অস্থির কণ্ঠস্বর। মুসাও নেই। আমার নাতি মিঙও গায়েব।
আট
নেকলেস চুরির খবর যে রাতে ফোনে কিশোরকে জানিয়েছে রবিন, তার পরদিন সকালে উঠে নাস্তা সেরে মিঙের সঙ্গে বেরোল সে আর মুসা, ভারড্যান্ট ভ্যালি দেখতে। সেই গুহা দেখতে যাবে, আঙুরের রস গাঁজিয়ে যেখানে মদ তৈরি হয়! মিঙ জানাল, পুকুরটা নতুন কাটা হয়েছে, কিন্তু ওই গুহা আর আশপাশের সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে অনেক আগে, খনি ছিল ওটা এক সময়।
সারাদিন বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই ছেলেদের, ঘুরবে, দেখবে কি আছে না আছে। বাড়ি গিয়ে কি হবে? নেকলেস চুরির রহস্য ভেদ করতে পারবে না তারা। শেরিফ হামফ্রের ধারণা ঠিক হলে, চোর এতক্ষণে নিশ্চয়ই স্যান ফ্রানসিসকোতে পৌঁছে গেছে, ওকে ধরা এখন পুলিশের পক্ষেও কঠিন। আরও একটা কারণে রাতের আগে ফেরার ইচ্ছে নেই। রিপোর্টার।
সকাল থেকেই খবরের কাগজের লোকজন আসতে শুরু করেছে, তিন কিশোরের অনুমান, নিশ্চয়ই এখন বাড়িতে গিজগিজ করছে লোকে। ছেকে ধরেছে মিস কৌনকে। জবাব দিতে দিতে জান খারাপ হয়ে যাচ্ছে হয়তো মহিলার। ফিরে গেলে তিন কিশোরকেও ওদের মুখোমুখি হতে হবে, ওই ঝামেলার মধ্যে থাকতে রাজি না ওরা।
আস্তাবল থেকে ঘোড়া নিয়ে এসেছে ওরা। ঘোড়ায় চড়তে ওস্তাদ মিঙ, মুসা আর রবিনও পারে-জিনার কাছে শিখেছে, তবে মিঙের মত নয়। জিনা আর মিঙ প্রতিযোগিতায় নামলে বোঝা যেত, দুজনের মাঝে কে বেশি দক্ষ।
বিষণ্ণ দেখাচ্ছে মিঙকে। শখানেক শ্রমিক থাকার কথা ছিল এখন, বলল সে, বেশ কয়েকটা ট্রাক থাকার কথা, আঙুর বোঝাই করে প্রেসিং হাউসে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। অথচ দেখো, মোটে বারো-তেরোজন লোক আছে। মাত্র একটা ট্রাক। ভূতের ভয়ে পালিয়েছে সব। দাদীমার সর্বনাশ হয়েই গেল। কিছুতেই ঠেকাতে পারবে না!
কোন জবাব জোগাল না রবিনের মুখে।
মিঙকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে মুসা বলল, এত ভেঙে পড়ছ কেন? আমাদের কিশোর তো আছে। রকি বীচে ভূতের রহস্য সমাধানে ব্যস্ত এখন সে। অসাধারণ বুদ্ধিমান, দেখো সমাধান করে ফেলবে। ভূতের ভয় না থাকলে আবার ফিরে আসবে শ্রমিকেরা।
খুব তাড়াতাড়ি কিছু করতে পারলে হত, বলল মিঙ, নইলে, অন্য জায়গায় কাজ নিয়ে নেবে শ্রমিকেরা। আজ সকালে সুই কি বলল জানো? আমিই নাকি সকল অনর্থের মূল, আমি অলক্ষুণে। আমি আসার পর থেকেই নাকি যত গোলমাল শুরু হয়েছে ভারড্যান্ট ভ্যালিতে।
বাজে কথা, জোর গলায় বলল রবিন, কুসংস্কার। অলক্ষুণে আবার হয় নাকি মানুষ?
মাথা নাড়ল মিঙ। জানি না। তবে এটা ঠিক, আমি আসার পর থেকেই একটার পর একটা গোলমাল হয়ে চলেছে। একসঙ্গে অনেক পিপা মদ একবার নষ্ট হয়ে গেল, পিপায় ফুটো হয়ে মদ পড়ে গেল, মেশিনের পার্টস ভাঙল। আরও নানারকম গণ্ডগোল। কিছুই যেন ঠিকমত চলতে চাইছে না।
তাতে তোমার কি দোষ? মুসা বলল।
কিছু কিছু অলক্ষুণে মানুষ থাকে না। বলল মিঙ, আমিও তেমনি একজন হতভাগ্য হয়তো। আমি হঙকঙে ফিরে গেলে হয়তো আবার সব ঠিক হয়ে যাবে, ভূত চলে যাবে, আবার হেসে উঠবে ভারড্যান্ট ভ্যালি। যদি শিওর হতে পারতাম, কালই চলে যেতাম। দাদীমার কষ্ট আমি সইতে পারি না।
এই বিষণ্ণতা কাটানো দরকার, নইলে দিনটাই মাটি হবে, ভাবল রবিন। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্যে বলল, এই ভারড্যান্ট ভ্যালি তোমারই হবে, না? আর কোন ভাগবাটোয়ারা নেই? দুপাশে পাহাড়ের দেয়াল, মাঝে যতদূর চোখ যায় শুধু আঙুরের ঝোঁপ, সেদিকে তাকিয়ে আছে সে।
দাদীমা তার সমস্ত সম্পত্তি আমাকেই উইল করে দিতে চায়। কিন্তু আমি ভাবছি, অর্ধেক ডলফ আংকেলকে দিয়ে দেব। এখানকার উন্নতির জন্যে অনেক করেছে সে। খেতখামার বাড়িয়েছে, নতুন মেশিন আনিয়েছে, আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ল মিঙ, অনেক লাভ হত। এক বছরেই শোধ করে দেয়া যেত ব্যাংকের ঋণ, কিন্তু সব শেষ করে দিল ওই হারামী ভূত।
সরু পথ ধরে ঝাঁকি খেতে খেতে ছুটে এল একটা জীপ, ওটাকে সাইড দেয়ার জন্যে পথের একেবারে কিনারে চলে এল তিন ঘোড়সওয়ার। খুব তেজি একটা কালো কোল্ট ঘোড়ায় চড়েছে মিঙ, মুসারটা কম বয়েসী ঘোটকী, চঞ্চল, সামলাতে অসুবিধেই হচ্ছে গোয়েন্দাসহকারীর, একটু এদিক ওদিক হলেই উল্টোপাল্টা কিছু করে বসবে ঘোড়াটা। রবিনেরটাও মাদী ঘোড়া, বয়স্ক, একেবারে শান্ত, যেভাবেই চালানো হচ্ছে, সেভাবেই চলছে।