হেডলাইটের আলো দেখা গেল। খানিক পরেই ছেলেদের পাশে এসে থামল জীপ।
এসো, ওঠো, ডাকল মরিসন, বাড়িতে দিয়ে আসি। কাজ আছে আমার। গাঁয়ে গিয়ে খুঁজে বের করতে হবে তিন হারামজাদাকে। শ্রমিকদেরও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করা দরকার।
হ্যাঁ, খুব জরুরী কাজ, বলল মিঙ। আপনি চলে যান না। মাত্র তো মাইলখানেক, আমরা হেঁটেই চলে যেতে পারব। এই যে, আপনার টর্চ। চাঁদ উঠছে, অসুবিধে হবে না আমাদের।
ঠিক আছে, মাথা কাত করল মরিসন। এতক্ষণে ভয় দেখিয়ে শ্রমিকদের ভাগিয়ে দিয়েছে কিনা হারামজাদারা, কে জানে।
ইঞ্জিনের গর্জন তুলে পাহাড়ী পথ ধরে উপত্যকার শেষ প্রান্তের আলোকগুচ্ছের দিকে চলে গেল ট্রাক।
ইসি, চলে যেতে যে বললাম, বলল মিঙ, তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না তো?
না না, অসুবিধে কিসের, তাড়াতাড়ি বলল রবিন, হাঁটতে বরং ভালই লাগবে। দেখতে দেখতে যাব।
ধুলো আর পাথরের কুচিতে ভরা আঁকাবাঁকা পথ. জ্যোৎস্নার আলোয় ধূসর। বাতাসে পাকা আঙুরের গন্ধ।
চলতে চলতে বলল মিঙ, ব্যবসায় লাল বাতি জ্বালিয়ে ছাড়বে ওই ভূত। শ্রমিকদের ঠেকানো যাবে না, চলে যাবেই। অনেক টাকা গচ্চা দিতে হবে। দাদীমাকে, মেশিনের টাকা শোধ করতে পারবে না। ক্ষেত খামার সব তার কাছ থেকে নিলাম করে নেবে ব্যাংক। একটু চুপ থেকে বলল, একটাই উপায় আছে এখন। মুক্তোর মালাটা। ওটা যদি পাওয়া যেত, বিক্রির করে ঋণ শোধ করে দেয়া যেত।
কেউ কোন জবাব দিল না। কি বলবে? নেকলেস কে পাবে, সেটা কৌন পরিবারের ব্যক্তিগত সমস্যা, আদালত নিষ্পত্তি করবে, এ-ব্যাপারে রবিন আর মুসা কি সাহায্য করতে পারবে?
এরপর আর কোন কথা হলো না। তিনজনেই চিন্তিত, চুপচাপ হাঁটতে থাকল। বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ আলোই নিভানো, কয়েকটা, শুধু জ্বলছে। আশপাশটা বড় বেশি শান্ত।
সিঁড়ি বেয়ে আঙিনায় উঠল ওরা। কারও সাড়া না পেয়ে অবাক হলো মিঙ। বিড়বিড় করল, গেল কোথায় সব? চাকরবাকরেরা না হয় ঘুমাতে গেছে, কিন্তু ডলফ আংকেল? তার তো এ-সময়ে হলে থাকার কথা। অফিসে?
অফিসরুমে রওনা হলো মিঙ, পেছনে দুই গোয়েন্দা। দরজা ভেজানো। টোকা দিল মিঙ। জবাবে গোঙানি শোনা গেল, আর ঘষার আওয়াজ।
সতর্ক হয়ে উঠল মিঙ, ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা। মেঝেতে পড়ে আছে। টার্নার, হাত-পা বাঁধা। বাদামী একটা কাগজের ঠোঙা মাথার উপর দিয়ে টেনে এনে মুখ ঢেকে দেয়া হয়েছে।
আংকেল! চেঁচিয়ে উঠে ছুটে গেল মিঙ।
মাথার ঢাকনাটা খুলতে শুরু করল আগে সে, রবিন আর মুসা তাকে সাহায্য করল। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন টার্নারের। কথা বলতে পারছে না, মুখে কাপড় বাধা।
দাঁড়ান, আগে বাঁধন কেটে নিই, হাত তুলল মিঙ, তারপর সব শুনব।
পকেট নাইফ বের করে আগে মুখের কাপড় কাটল সে, তারপর হাত পায়ের বাঁধন খুলতে শুরু করল। জোরে জোরে দম নিচ্ছে টার্নার। বাঁধন কাটা হতেই কব্জি আর গোড়ালি ডলতে শুরু করল।
কি হয়েছিল? জানতে চাইল মুসা।
বাড়িতে ফিরে অফিসে ঢুকলাম। দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিল ব্যাটা। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল, কোথা থেকে আরেকটা এসে হাজির হলো। দুজনে মিলে আমাকে মেঝেতে ফেলে বেঁধে ফেলল। তারপর ঠোঙাটা টেনে দিল মাথায়।সেফের দরজা খোলার শব্দ…সেফ! লাফ দিয়ে আয়রন সেটার দিকে ছুটে গেল সে।
ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে আছে পাল্লা। ঝটকা দিয়ে একটানে খুলে ফেলল পুরোটা। খোঁজাখুঁজি করল। ঘুরল ধীরে ধীরে। মুখ ফ্যাকাসে।
নেকলেসটা, ফিসফিস করে বলল সে, নেই!
সাত
বসার ঘরে চুপচাপ বসে আছে কিশোর, একা। চাচা-চাচী বাড়ি নেই। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে সে, চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। হঠাৎ সোজা হলো, ঠোঁটের কাছ থেকে সরে এল হাত। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, যত জোরে পারে। অপেক্ষা করতে লাগল।
বারান্দায় পায়ের আওয়াজ হলো। খানিক পরেই দরজায় উঁকি দিল বোরিস, বিশালদেহী দুই ব্যাভারিয়ান ভাইয়ের একজন, ইয়ার্ডের কর্মচারী! তার ভাই রোভার গেছে মেরিচাচী আর রাশেদ চাচার সঙ্গে, স্যান ডিয়েগোতে।
কি হয়েছে, কিশোর? বোরিস উদ্বিগ্ন।
শোনা গেছে তাহলে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর।
যাবে না? বাড়ি ফাটিয়ে ফেলেছ। তোমার জানালা খোলা, আমার জানালা খোলা। কি ব্যাপার, বাড়িটাড়ি মেরেছে? কিশোরের মাথা আর কাঁধে চোখ বোলাচ্ছে। বোরিস।
ফিরে তার ঘরের জানালার দিকে তাকাল কিশোর, খোলা। চোখে ক্ষোভ জমল।
কি ব্যাপার? আবার জানতে চাইল বোরিস। কিছু হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
হয়নি, শুধু জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি।
তাহলে চেঁচালে কেন?
চিৎকার প্র্যাকটিস করছিলাম।
কিশোর, তুমি ঠিক আছ? ভুরু কোঁচকাল বোরিস। অসুস্থ নও তো? হোকে (ওকে)?
ইয়েস, হোকে, হাসল কিশোর! আপনি যান, ঘুমোেনগে। আজ রাতে আর চেঁচাব না।
ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে, সন্দেহ যাচ্ছে না বোরিসের। কিন্তু আর কিছু বললও না, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল তার ঘরে। দুভাই একই ঘরে থাকে, মূল বাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে ছোট্ট একটা কটেজে।
যেখানে ছিল সেখানেই বসে রইল কিশোর। মগজে চিন্তার ঘূর্ণিপাক। কি যেন একটা আসি আসি করছে মনে, কিন্তু আসছে না, সবুজ ভূতের ব্যাপারে। ক্ষান্ত দিয়ে শেষে উঠে পড়ল। শোয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
দোতলায় যাওয়ার জন্যে উঠল। আচ্ছা, রবিন আর মুসা কি করছে?-ভাবল সে। যেন তার প্রশ্নের জবাব দিয়েই বেজে উঠল টেলিফোন। দুই লাফে গিয়ে রিসিভার তুলে নিল সে। কি ব্যাপার, রবিন? ভূতটা আবার দেখেছ?