আমারও না। কল্পনা, স্রেফ কল্পনা। ভূত নিয়ে এত বেশি আলাপ আলোচনা করেছে, ছায়া দেখলেই ভূত ভাবে এখন।
কল্পনাই হোক আর যাই হোক, ক্ষতি যা করার করে ফেলেছে, এতক্ষণ। চুপচাপ কথা শুনছিল টার্নার। যাও, গাঁয়ে গিয়ে দেখো, বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করতে পার কিনা শ্রমিকদের। মনে হয় না খুব একটা লাভ হবে।
হবে না। বাড়ি দিয়ে আসব আপনাকে? বলল মরিসন।
হ্যাঁ…হায় হায়, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে কপালে চাপড় মারল টার্নার। মিঙ! নেকলেস রেখে সেফে তালা লাগিয়েছিলাম? মনে আছে?
কি জানি, খেয়াল করিনি, বলল মিঙ।
আমার মনে হয়, স্মৃতির আনাচে-কানাচে হাতড়ে বেড়াল মুসা, আমার মনে হয়…হ্যাঁ, নেকলেসটা রেখে জোরে দরজা বন্ধ করেছিলেন, হ্যাঁণ্ডেল ঘুরিয়েছিলেন।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কিন্তু ডায়াল ঘুরিয়েছিলাম?
ভাবল মুসা। মনে করতে পারছে না। না বোধহয়। দরজা লাগিয়েই তো ছুটলেন…
আমারও তাই মনে হচ্ছে, অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেছে টার্নারের কণ্ঠ। শ্রমিকেরা ভূত দেখেছে শুনে এতই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তালা লাগানোর কথাও মনে হয়নি। মরিসন, জলদি, জলদি বাড়ি নিয়ে চলো আমাকে। ছেলেরা থাক এখানেই। ফিরে এসে নিয়ে যেয়ো।
ঠিক আছে। মিঙ, এই যে, আর টর্চটা রাখো, শক্তিশালী একটা টর্চ মিঙের হাতে গুঁজে দিয়ে জীপে গিয়ে উঠল মরিসন। টার্নার আগেই উঠে বসেছে। স্টার্ট নিয়ে চলে গেল জীপ। জ্যাক চলে গেল গ্রামের দিকে।
কি কাণ্ড! ইঞ্জিনের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে বলল রবিন। প্রথমে বাড়িতে ভূত, তারপর এখানে। কিন্তু, মিঙ, ভূত দেখা নিয়ে সবাই এত উতলা হয়ে উঠেছে। কেন?
নীরব অন্ধকারে নিজেদের অজান্তেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এসেছে তিন কিশোর। পরিবেশ আরও ভয়াবহ করে তুলেছে পোকামাকড়ের একটানা কর্কশ চিৎকার।
এখন আঙুর তোলার পুরো মৌসুম, মিঙ বলল। রোজই আঙুর পাকছে, তুলে এনে প্রেসিং মেশিনে ফেলছে শ্রমিকরা। রস বের করে রাখা হচ্ছে। ঠিক সময়ে তোলা না হলে বেশি পেকে যাবে, কিংবা পচে যাবে, ভাল মদ আর তৈরি হবে না ওগুলো দিয়ে। থেমে অন্ধকারেই এদিক ওদিক তাকাল। আঙুর তুলতে অনেক লোকের দরকার, কিন্তু সারা বছর এই কাজ হয় না। তাই মৌসুমের সময়ই শুধু আসে শ্রমিকেরা, তারপর চলে যায় অন্য কোথাও। অনেক দেশের লোক আছে। মেকসিকান আর এশিয়ানই বেশি, আমেরিকানও আছে কিছু। দরিদ্র লোক ওরা, কর্মঠ, কুসংস্কারে বোঝাই ওদের মন, বলে গেল মিঙ। রকি বীচে ভূত দেখা যাওয়ার খবর শুনেই শ্রমিকেরা বিচলিত হয়ে উঠেছিল। এখানেও দেখা গেছে শুনলে আর থাকবে না, কোন কিছুর বিনিময়েই ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, পালাবে। খেতে আঙুর পচে নষ্ট হবে, তুলে না আনা গেলে রসও হবে না, যাবে এ বছরের ফসল। অনেক টাকা গচ্চা দিতে হবে দাদীমাকে। এমনিতেই সময় এখন ভাল যাচ্ছে না তার, অনেক টাকা ঋণ, তার ওপর ফসল নষ্ট হলে…সে-জন্যেই এত ভেঙে পড়েছে। দাদীমা।
হুঁ, মুশকিল, সহানুভূতির স্বরে বলল মুসা। সব দোষ তোমার দাদার বাবার। ওর ভূত বাইরে বেরোনোতেই তো যত গণ্ডগোল।
না, জোর দিয়ে বলল মিঙ, আমি বিশ্বাস করি না। দাদার বাবা আমাদের ক্ষতি করতে পারে না, হাজার হোক তার রক্ত আমরা। ওটা অন্য কোন শয়তান লোকের ভূত।
এত প্রত্যয়ের সঙ্গে কথাটা বলল মিঙ, রবিনের ইচ্ছে হলো বিশ্বাস করে ফেলে। কিন্তু কৌন ম্যানশনে ভূতটাকে দেখেছে সে, দেখেছে ঢোলা সবুজ আলখেল্লা। যদি ওটা ভূত হয়, বুড়ো ফারকোপার ছাড়া আর কারও না।
এক মুহূর্ত নীরব রইল তিনজনেই। কি বলবে ভাবছে। অবশেষে বলল রবিন, দেখতে পারলে শিওর হতাম রকি বীচ আর এখানকারটা একই ভূত কিনা।
শিওর হলে কি হবে? ভূত ভূতই, তা যার ভূতই হোক, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। ইস, কিশোরটা যদি থাকত এখন।
এই ভূতটা এখনও কারও কোন ক্ষতি করেনি, বলল মিঙ। শুধু দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। ভয়ের কিছু নেই। আর যদি দাদার বাবার ভূত হয়ই, তাহলে তো আরও ভয় নেই, আমাদের ক্ষতি করতেই পারে না। রবিন, চলো না এক নম্বর প্রেসিং হাউসে দেখি, এখনও আছে কিনা।
রবিন আর মুসাকে নিয়ে বিল্ডিংটার চারপাশে একবার চক্কর দিল মিঙ। জায়গাটা তার ভালমত চেনা, টর্চ জ্বালার প্রয়োজনই বোধ করল না। আলো জ্বালল না আরও একটা কারণে, অন্ধকারে ছাড়া দেখা দেয় না ভূতটা।
চেয়ে চেয়ে চোখ ব্যথা করে ফেলল ওরা, কিন্তু ভূতের দেখা নেই, শুধু। অন্ধকারে বাড়িটার কালো ছায়া, বিরাট আরেকটা ভূতই যেন। হাঁটতে হাঁটতেই মিঙ জানাল, আঙুর এনে এখানে বড় বড় ট্যাংকে রাখা হয়। মেশিনের সাহায্যে চিপে রস বের করা হয়, সেই রস গড়িয়ে গিয়ে জমা হয় অন্য ট্যাংকে। সেখান থেকে পাম্পের সাহায্যে নিয়ে যাওয়া হয় মদ চোলাইয়ের কারখানায়। সে এক এলাহি কাণ্ড। পাহাড়ের বিরাট গুহার ভেতরে ছোট পুকুর কাটা হয়েছে, তাতে জমা হয় আঙুরের রস, বিশেষ পদ্ধতিতে মদ তৈরি হতে থাকে। সারা বছরই উত্তাপ আর আর্দ্রতা এক রকম থাকে গুহার ভেতরে, মদ বানানোর জন্যে এটা খুব দরকার।
মিঙের কথায় বিশেষ মন নেই রবিনের। সে ভূতটাকে খুঁজছে।
চলো, ভেতরে যাই, বলল মিঙ। মেশিন আর ট্যাংকগুলো দেখাব। একেবারে নতুন, মাত্র গত বছর কেনা হয়েছে। কিনে এনেছে উলফ আংকেল। বাকিতে। অনেক টাকা। কি করে শোধ করবে ভাবছে দাদীমা। তার ধারণা, এত টাকা। কোনদিনই শোধ করতে পারবে না।