শ্রমিকরা ভয় পাবে ভাবছেন? বলল মিঙ।
পাবে মানে? সর্বনাশ হয়ে যাবে! উত্তেজনা দমন করল টার্নার। প্রসঙ্গ বদলে বলল, যাকগে, মেহমানদের অস্থির করে দেয়াটা উচিত হচ্ছে না। রবিন আর মুসাকে বলল, তোমরা এসব নিয়ে কিছু ভেব না। তো, গোস্ট পার্লের ব্যাপারে আগ্রহ আছে? গতকাল তো ভালমত দেখোনি, আজ দেখতে চাও?
একই সঙ্গে মাথা কাত করল মুসা আর রবিন।
খাওয়ার পর দুই গোয়েন্দাকে নিয়ে চলল টার্নার। ডাইনিং রুমের লাগোয়া মাঝারি একটা হল পেরিয়ে ছোট একটা অফিসঘরে ওদেরকে নিয়ে এল সে। চকচকে পালিশ করা বড় একটা টেবিল, টেলিফোন, কয়েকটা ফাইলিং কেবিনেট, আর ঘরের কোণে পুরানো একটা আয়রন সেফ রয়েছে।
ঝুঁকে বসে সেফের ডায়াল ঘোরাতে শুরু করল টার্নার। ক্লিক শব্দ করে খুলে গেল তালা। কার্ডবোর্ডের ছোট একটা বাক্স হাতে ফিরে এল আবার ছেলেদের কাছে। টেবিলে বাক্সটা রেখে ডালা খুলল। নেকলেসটা বের করে রাখল একটা সবুজ ব্লটিং পেপারের ওপর।
ঝুঁকে এল মুসা আর রবিন, তাদের পাশে মিঙ। বড় বড় মুক্তো, একেকটার আকার একেক রকম, ধূসর রঙ। কেমন জানি মুক্তোগুলো। রবিনের মায়ের একটা মুক্তোর হার আছে, মুক্তোগুলোর কিছু লাল, কিছু শাদা, চকচকে, মসৃণ, কিন্তু এই মুক্তোগুলো ওরকম নয়। আঙুল বুলিয়ে দেখল, কেমন খসখসে।
এমন মুক্তো আর দেখিনি, বলল মুসা।
এজন্যেই এগুলোর নাম রাখা হয়েছে গোস্ট পার্ল, বলল টার্নার। এগুলো তোলা হয়েছিল ভারত মহাসাগরের একটা ছোট উপসাগর থেকে। প্রাচ্যের ধনীরা এগুলোর খুব দাম দেয়, কিন্তু আমি বুঝি না কেন। যেমন বাজে চেহারা, তেমনি রঙ। এখনও নেকলেসটার দাম দশ-পনেরো লাখ ডলারের কম না।
আরিব্বাবা, তাই নাকি? ভুরু কুঁচকে গেল মিঙের। তাহলে তো সমস্যা মিটে গেল। এটা বিক্রি করেই সমস্ত ঋণ শোধ করতে পারবে দাদীমা, বেঁচে যাবে আঙুরের খেত। নেকলেসটা নিশ্চয়ই দাদীমা পাবে?
কিছু অসুবিধে আছে, মাথা নেড়ে বলল টার্নার। ফারকোপার কৌন নেকলেসটা তার চীনা স্ত্রীকে দান করে দিয়েছিলেন। আইনত এখন ওটা মহিলার কোন নিকট আত্মীয়ের পাওনা।
কিন্তু তার পরিবার তাঁকে ত্যাগ করেছে, অবাক হয়ে বলল মিঙ। তাছাড়া চীনের বিপ্লব আর যুদ্ধের সময় তাঁর পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কেউ বেঁচে আছে। কিনা সন্দেহ।
আছে, ভুরুর ওপরে জমে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছল টার্নার। স্যান ফ্রানসিসকোতে এক চীনা উকিল আছে, সে চিঠি দিয়েছে আমাকে। চীনা মহিলার বোনের এক বংশধর নাকি বেঁচে আছে। নেকলেসটা সাবধানে রাখতে বলেছে, যে কোন সময় ওটা নিতে আসতে পারে। তবে এত সহজে দিচ্ছি না। কেস করবে, করুক। কে পাবে ওটা, সাক্ষী-প্রমাণ নিয়ে রায় দিতে দিতে কয়েক বছর লেগে যাবে, আদালতের।
কপাল কুঁচকে গেল মিঙের। মুখ খুলতে গিয়েও পায়ের শব্দ শুনে থেমে গেল। তাড়াহুড়ো করে কে জানি আসছে। দরজায় জোরে ধাক্কা দিল কেউ।
কে? এসো, ডাকল টার্নার।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লম্বা চওড়া, মাঝবয়েসী, কালো এক লোক। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ছেলেদের যেন দেখতেই পেল না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মিস্টার টার্নার, এক নম্বর প্রেসিং হাউসের কাছে ভূত দেখা গেছে। তিনজন মেকসিকান শ্রমিক দেখেছে, আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে ওরা। আপনার যাওয়া দরকার।
সর্বনাশ! গুঙিয়ে উঠল টার্নার। এখুনি যাচ্ছি, চলো। তাড়াতাড়ি নেকলেসটা সেফে ভরে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর তিন কিশোরকে নিয়ে কালো লোকটার পেছনে পেছনে ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে। জীপ অপেক্ষা করছে। চড়ে বসল তাতে। গর্জে উঠল ইঞ্জিন। দুপাশের পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে অন্ধকার উপত্যকা ধরে ছুটে চলল গাড়ি।
পথ খুব খারাপ, উঁচুনিচু, এবড়োখেবড়ো, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। কিন্তু মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ, তাই রক্ষা। নিচু একটা পাকা বাড়ির সামনে এসে থেমে গেল জীপ। কংক্রিট আর ইটের তৈরি মজবুত দেয়াল, হেডলাইটের আলোয় দেখল দুই গোয়েন্দা। বাড়িটা নতুন।
লাফিয়ে জীপ থেকে নামল সবাই। আঙুরের রসের তীব্র সুবাসে বাতাস ভারি, সদ্য পিষে বের করা হয়েছে রস।
ও মিস্টার মরিসন, কালো লোকটার পরিচয় দিল মিঙ, ফোরম্যান। খেত লাগানো আর আঙুর তোলার দায়িত্ব তার।
বাড়ির অন্ধকার ছায়া থেকে বেরিয়ে এল এক তরুণ, পরনের কাপড়ে বালি আর ময়লা।
হেডলাইট নিভিয়ে দিল মরিসন। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, জ্যাক, আমি যাওয়ার পর আর কিছু দেখা গেছে?
না, স্যার, আর কিছু দেখা যায়নি, জবাব দিল জ্যাক।
ওই তিন ব্যাটা কোথায়?
কি জানি। আপনি যাওয়ার পরই ভেগেছে। দৌড়ে, হেসে উঠল জ্যাক, সে কি দৌড়। বোধহয় কাফেতে গিয়ে ঢুকেছে, হাত তুলে উপত্যকার শেষ প্রান্তে এক গুচ্ছ আলো দেখাল সে। ভূত দেখার গল্প বলছে সবাইকে।
মেরেছে! মরিসনের কণ্ঠে শঙ্কা। যেতে দিলে কেন?
ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। রাখতে পারিনি। এমনই ভয় পেয়েছে।
হুঁ, আগুনে কেরোসিন পড়ল! তিক্ত হয়ে উঠেছে মরিসনের কণ্ঠস্বর। ব্যাটারা এখানে অন্ধকারে কি করছিল?
আমিই আসতে বলেছিলাম, এখানে দেখা করতে বলেছিলাম আমার সঙ্গে। ভূতের কিচ্ছা ওরাই ছড়াচ্ছিল, তাই ধমকে দিতে চেয়েছিলাম, বেশি শয়তানী করলে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেব। আমার আসতে দেরি হয়ে গেল, ওরা অপেক্ষা করেছিল। এখনে অন্ধকারে। তখনই নাকি কি একটা দেখেছে, আমার বিশ্বাস হয় না।