স্যান ফ্রানসিসকো শহরটা ভালমত দেখার ইচ্ছে ছিল মুসা আর রবিনের, কিন্তু হতাশ হতে হলো। শহরের ভেতরে গেল না গাড়ি, মোড় নিয়ে বেরিয়ে এল এক প্রান্ত দিয়ে। উঠে পড়ল হাইওয়েতে। পথের দুধারে কোথাও পাহাড়, কোথাও খোলা জায়গা।
অনেক বড় আঙুরের খেত তোমার দাদীর, না? এক সময় জিজ্ঞেস করল মুসা।
অনেক বড়, বলল মিঙ। গেলেই দেখবে। মদ চোলাইয়ের কারখানাও আছে। দাদীমা বলে, সব আমাকে দিয়ে যাবে। কিন্তু আমার কেন জানি নিতে ইচ্ছে করে না।
আগ্রহ প্রকাশ করল রবিন আর মুসা। অনেক কথাই জানাল মিঙ যেতে যেতে।
জানা গেল, ফারকোপার কৌনের প্রপৌত্র মিঙ কৌন। চীনা রাজকুমারী ছিল। ফারকোপারের দ্বিতীয় স্ত্রী, প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিয়ে করেছিল।
যেখানেই যেত, প্রথম স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেত ফারকোপার, জাহাজে যখন সে দূর সাগরে পাড়ি জমাত, তখনও কাছছাড়া করত না। এমনি এক ভ্রমণের সময়েই সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল মহিলা। সদ্যপ্রসূত ছেলেকে নিয়ে মুশকিলে পড়ল ফারকোপার, হংকং থেকে রওনা হয়েছিল, তাড়াতাড়ি ফিরে গেল আবার ওখানেই।
শিশুর দেখাশোনা কে করবে? ফারকোপারের পক্ষে সম্ভব নয়। হংকঙের এক আমেরিকান মিশনারিতে ছেলেকে রাখার ব্যবস্থা করল। এর কিছুদিন পরেই রাজবংশের লোকের সঙ্গে গোলমাল বাধল তার, সুন্দরী রাজকুমারীকে বিয়ে করা নিয়ে। আর থাকা যাবে না চীনে, বুঝে ফেলল। শেষে গোস্ট পার্ল চুরি করে বৌকে নিয়ে পালিয়ে এল আমেরিকায়। তার ছেলে রয়ে গেল হংকঙেই।
সেই ছেলে, রবার্ট কৌন বড় হলো, লেখাপড়া শিখল, কিন্তু আমেরিকায় আর ফিরল না। মিশনারির ডাক্তার হিসেবে থেকে গেল হংকঙেই, বিয়ে করল এক চীনা তরুণীকে। এক ছেলে হলো তাদের, জেমস। কয়েক বছর পরেই পীত জ্বরে প্রায়। একই সঙ্গে মারা গেল জেমসের বাবা-মা, এতিম ছেলেটাকে নিয়ে এল মিশনারি। বড় হতে লাগল ছেলে, বড় হয়ে বাবার মতই ডাক্তার হলো সে-ও। হংকঙেই থেকে গেল। বিয়ে করল এক ইংরেজ মিশনারির মেয়েকে। তাদেরই ছেলে মিঙ। মিঙের যখন কয়েক বছর বয়েস, পীত নদীতে নৌকাডুবিতে মারা গেল তার বাবা-মা। এতিম শিশুর দায়িত্ব নিতে হলো আবার মিশনারিকে।
এ-পর্যন্ত বলে থামল মিঙ। দীর্ঘশ্বাস চাপল।
চুপ করে রইল রবিন আর মুসা।
সামলে নিয়ে আবার কথা শুরু করল মিঙ, নৌকায় আমিও ছিলাম। কিন্তু বেঁচে গেলাম, বাঁচাল জেলেরা। ওরাই পৌঁছে দিয়েছে মিশনারিতে। আমার দাদা আর বাবা যেখানে বড় হয়েছে, সেখানে নয়, অন্য এক মিশনারিতে কয়েক বছর গেল। আমি কে, বাড়ি কোথায় কিছুই জানি না তখন। জানার জন্যে পাগল হয়ে উঠলাম। শেষে মিশনারি স্কুলের একজন শিক্ষককে বললাম। আমার বাবা আর মায়ের ডাকনাম শুধু জানি, আর জানি আমার বাবা ডাক্তার ছিল। আর দুজনেই যে। মিশনারির লোক ছিল, একথা জেলেরাই জানিয়ে গেছে, আমাকে দিয়ে যাওয়ার সময়। পুরানো রেকর্ড ঘেঁটে অনেক কষ্টে আমার পরিচয় বের করলেন স্যার। কিভাবে কিভাবে খোঁজ করে দাদীমার নাম-ঠিকানা জোগাড় করলেন তিনি, চিঠি পাঠালেন তাঁর কাছে।
দাদীমাই আমাকে আমেরিকায় নিয়ে এসেছে। তারপর তার সঙ্গেই আছি। আমাকে খুব ভালবাসে। এতদিন ভালই ছিলাম আমরা, হঠাৎ করে আমার দাদার বাবার ভূত এসে গোলমাল করে দিয়েছে সব। খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছে দাদীমা। ডলফ আংকেল অবশ্য তাকে শান্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করছে। আমিও দাদীমাকে সাহায্য করতে চাই, তার ভাল চাই।
ভূতের ব্যাপারে তোমার কি মনে হয়?
বুঝতে পারছি না।
এরপর আর বিশেষ কোন কথা হলো না। উত্তেজনায় ভরা দিন গেছে। ঢুলুঢুলু। হয়ে এসেছে মুসার চোখ, রবিনও হাই তুলছে। নরম গদিতে আরামে হেলান দিয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়।
গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলল রবিন। উঁচু পাহাড়ের ওপাশে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। পাথর আর কাঠে তৈরি বিশাল এক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে গাড়ি। দুপাশে। পাহাড়। ছোট্ট একটা উপত্যকায় বাড়িটা। আশপাশে তাকিয়ে দেখল সে। ইতিমধ্যেই পাহাড়ের গোড়ায় অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাইলের পর মাইল বিছিয়ে থাকা খেত, কালো ছোট ছোট ঝোঁপ, নিশ্চয়ই আঙুর লতার ঝড়।
মুসা, ওঠো, ধাক্কা দিল রবিন।
চোখ মেলল মুসা। মুখের কাছে হাত নিয়ে এসে হাই তুলল বড় করে। তারপর উঠে দাঁড়াল।
মেহমানদের পথ দেখাল মিঙ। চওড়া কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল বাড়ির এক পাশের ছোট্ট আঙিনায়।
এটাই দাদীমার বাড়ি, বলল মিঙ। চলো, আগে তার সঙ্গে দেখা করি।
রেডউডের প্যানেল করা বিরাট এক হলরুমে এসে ঢুকল ওরা। লম্বা, সম্ভ্রান্ত চেহারার এক মহিলা এগিয়ে এলেন হাসিমুখে, স্বাগত জানালেন ছেলেদের।
কোন অসুবিধে হয়নি তো? জিজ্ঞেস করলেন মহিলা। তোমরা এসেছ, খুব। খুশি হয়েছি।
কোন রকম অসুবিধে হয়নি, জানাল রবিন আর মুসা।
তাদেরকে ডাইনিং রুমে নিয়ে চললেন মহিলা।
জানি, খিদে পেয়েছে তোমাদের, বললেন দিনারা কৌন, বসো, চেয়ারে বসো। আজ আমার শরীরটা ভাল নেই। তাছাড়া সারাদিন খুব কাজের চাপ গেছে। কাল তোমাদের সঙ্গে কথা বলব, হ্যাঁ? ব্রোঞ্জের ছোট একটা ঘণ্টা বাজালেন তিনি। মাঝবয়েসী এক চীনা পরিচারিকা এসে ঢুকল।
ছেলেদের খাবার দাও, সুই, নির্দেশ দিলেন মিস কৌন। মিঙ, তোরও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?