শান্ত রয়েছে কিশোর, গভীর মনোযোগে দেখছে অতিথিদের কাণ্ড! নতুন কেউ ঢোকেনি ঘরে। ছাতের দিকে চেয়ে আছে ভ্যারাড, স্থির।
অবশেষে পিছিয়ে যেতে শুরু করল জিনা। ছেলেরা অনুসরণ করল। তাকে। নিঃশব্দে চলে এল খোয়া বিছানো পথে। গান চলছেই, জ্যান্ত অশরীরী কিছু একটার মত তাদের সঙ্গে চলেছে যেন কুৎসিত শব্দ।
পেছনের চত্বরে চলে এল চারজনে। প্রাসাদের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল জিনা। আস্তে আস্তে ভয় কেটে যাচ্ছে রবিন আর মুসার।
এই গান শুনেই পালিয়েছিল রুজ? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল শুধু জিনা, মুখে কিছু বলল না।
আমিও পালাতে চাই, চুলে আঙুল চালাচ্ছে মুসা।
গভীর শ্বাস টানল জিনা। আমি চাই না, কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা। এটা আমার বাড়ি। খালা থাকতে চাইলে থাকবে, কিন্তু ভ্যারাডকে যেতে হবে। এখান থেকে!
কিন্তু অকাজটা ভ্যারাডের নয়, তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। ওর মুখের একটা পেশীও নড়েনি, দেখেছি। ও শব্দ করেনি।
ও করেনি, কিন্তু এতে ওর হাত আছেই, ভোতা গলায় বলল জিনা।
গ্যারাজে অস্থিরভাবে পা ঠকল কমেট, মৃদু চিহিহি করে উঠল।
মে-ট! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। গ্যারাজে ঢুকেছে কেউ!
প্রায় লাফিয়ে উঠে ছুটল কিশোর। গিয়ে এক টান মেরে খুলে ফেলল গ্যারাজের দরজা, পরক্ষণেই জোরে এক ধাক্কা খেয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। দুপদাপ পা ফেলে খোলা জায়গাটার দিকে ছুটে গেল কালো একটা মূর্তি।
কিশোর! চেঁচিয়ে উঠে গোয়েন্দাপ্রধানের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল মুসা।
আমি ঠিকই আছি, ধীরে ধীরে বলল কিশোর। লোকটা কে, দেখেছ?
মোটকা! জবাবটা দিল রবিন। বেশি লম্বা না। গোঁফ আছে মনে হলো, আঁটার মত গোঁফ।
নজর তো খুব কড়া! জিনার কণ্ঠে শ্রদ্ধা। অন্ধকারে দেখলে কী করে এত কিছু?
অন্ধকার কোথায় দেখছ? কিশোর বলল। তারার আবছা আলো আছে না? নজর কড়া না হলে গোয়েন্দা হবে কী করে? গান যে থেমে গেছে খেয়াল করেছ?
রান্নাঘরে আলো জ্বলল, গ্যারাজের ছায়ায় লুকিয়ে পড়ল ছেলেরা।
দরজা খুলে গেল রান্নাঘরের। কে? মিস মারভেলের গলা।
আমি, খালা, জবাব দিল জিনা।মেটকে দেখতে এসেছি।
বড় বেশি বেশি করো তুমি ঘোড়াটাকে নিয়ে! বিরক্তি ঝরল মিস মারভেলের কণ্ঠে। এসো, জলদি এসো। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
গাড়ি-বারান্দায় ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো।
পার্টি বোধহয় ভাঙল, চাপা গলায় বলল রবিন।
সকালে এসো আবার, জিনা অনুরোধ করল।
আসব, বলল কিশোর।
খোয়া বিছানো পথে জিনার হালকা পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
চলো, আমরাও কেটে পড়ি, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে মুসা। আবার। কখন শুরু হয়ে যায় গান, কে জানে!
পাঁচ
পরদিন সকালে, বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। তারের বেড়া দেয়া মাঠে ঘাস খাচ্ছে আপালুসাটা, তা-ই দেখছে।
চমৎকার স্বাস্থ্য! মুসা বলল এক সময়। অনেক মানুষেরই থাকে না।
এবং কোন মানুষই ঘাস খায় না, পিছন থেকে শোনা গেল জিনার গলা। তোমার যে কথা! ঘোড়া আর মানুষ এক হলো নাকি?
ঘুরে তাকাল ছেলেরা। জিনার পরনে জিনসের প্যান্ট, কড়া ইস্ত্রী করা শার্ট। তারপর? কিছু ভেবেছ! কীসে গান গায়, বুঝেছ কিছু?
গতরাতে আর কিছু ঘটেছে? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর, পারকার, হাউসের দিকে দৃষ্টি ফেরাল।
না, গলা সমান উঁচু বেড়া ডিঙিয়ে এপাশে চলে এল জিনা। আচ্ছা, লোকটা গ্যারাজে লুকিয়ে ছিল কেন, বলো তো?
জানি না, হেসে মাথা নাড়ল রবিন। ওর সঙ্গে তো আর আমাদের। কথা হয়নি। তবে অনুমান করতে পারি। হয়তো চোর, বাড়িতে ঢোকার পথ খুঁজছিল। কিংবা ভবঘুরে, রাত কাটানোর জন্যে ঢুকেছিল গ্যারাজে।
ওই বিচ্ছিরি গান গাওয়ার জন্যেও ঢুকে থাকতে পারে, কিশোর। বলল। মনে আছে, ভ্যারাড বলেছিল, অনেক দূর থেকে আসতে পারে মহাসর্পের গান?
কিন্তু সাপ তো গান গায় না, প্রতিবাদ করল জিনা। সেটা মহাই হোক, আর সাধারণ সাপই হোক। কেবল হিসহিস করতে পারে।
একটা কথা ভুলে যাচ্ছ, যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর। হিউগ ভ্যারাড আসার আগে ওই গান কখনও শোনোনি। তার মানে ওসবের সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত লোকটা। তবে এ-ও ঠিক, গতরাতে গান যখন চলছিল, ডাইনিং রুমে চেয়ারে চুপচাপ বসেছিল সে, স্পষ্ট দেখেছি, যেন ঘোরের মধ্যে ছিল।
টেপরেকর্ডার ব্যবহার করে না তো? মুসা প্রশ্ন রাখল। হয়তো গোঁফওয়ালা লোকটার সঙ্গে আগেই পরামর্শ করে নিয়েছিল ভ্যারাড। ঠিক সময় এসে ডাইনিং রুমের কাছাকাছি কোথাও যন্ত্রটা বসিয়ে চালু করে। দিয়ে, গ্যারাজে গিয়ে লুকিয়ে বসেছিল লোকটা। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়াতক অপেক্ষা করত ওখানে, কমেটের জন্যে পারেনি।
তা হতে পারে, সায় দিল কিশোর। কিন্তু চট করে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। এমনও হতে পারে, গোঁফের সঙ্গে ভ্যারাডের কোন সম্পর্কই নেই।
ঠোঁট বাকাল জিনা। তার মানে, যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই রয়ে গেছি! ভ্যারাড ব্যাটাও যাচ্ছে না আমার বাড়ি থেকে, ওই নাট-ঢিলা লোকগুলোও আসতেই থাকবে!
গতরাতের অতিথিরা তো? কিশোর বলল। ঠিকই বলেছ, সত্যিই নাট-ঢিলা! ওই রাসলারটা তো একটা খাটাস, স্বভাব-চরিত্রও বিশেষ সুবিধের মনে হলো না।
ব্যাটা খাবারের দোকান চালায় কী করে! স্বাস্থ্য দপ্তর যে ওর লাইসেন্স এখনও ক্যানসেল করেনি, সেটাই আশ্চর্য!