লাল-চুলো মহিলার পাশে সোনালি-চুলো আরেক মহিলা। আঁটসাট হালকা সবুজ পোশাক ছিঁড়ে-ফেটে বেরিয়ে যাবে যেন থলথলে মাংসল শরীর। তার পাশেই দাঁড়িয়েছে পঞ্চম লোকটা, পার্টিতে বেমানান। অন্য সবাই দাঁড়িয়েছে সোজা হয়ে, সে দাঁড়িয়েছে সামান্য কুঁজো হয়ে, সুযোগ পেলেই বসে পড়তে ইচ্ছুক যেন। অন্যেরা পার্টির জন্যে বিশেষ পোশাক পরে এসেছে খুব সাবধানে বাছাই করে, কিন্তু ওই লোকটা অতসবের ধার ধারেনি, হাতের কাছে যা পেয়েছে, তা-ই তাড়াহুড়ো করে পরে চলে এসেছে বোধহয়। পুরানো মলিন জ্যাকেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ময়লা স্পোর্টস শার্ট, তার নিচ থেকে বিচ্ছিরিভাবে বেরিয়ে আছে টি শার্টের খানিকটা। উস্কোখুস্কো ধূসর চুলে কতদিন চিরুনি আর নাপিতের কাচি পড়েনি, কে জানে!
এখান থেকে কথা শোনা যাবে না, আরও সামনে এগোনোর ইশারা করল জিনা। ফিসফিস করে বলল, সব কটার মাথায় ছিট আছে!
ওরা ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
জানি না, মাথা নাড়ল জিনা। মেহমানদের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছিলাম, ভ্যারাডের বাচ্চা এমন একখান চাউনি দিল না আমাকে! মরা মাছের চোখের মত ঠাণ্ডা ব্যাটার চোখ, গা শিরশির করে তাকালে! ময়লা জ্যাকেট পরে আছে যে লোকটা ওর নাম রাসলার, খাবারের দোকানের মালিক। কমলা গাউন পরা কঙ্কালটার নাম জেরি গ্যানারিল, নাপতিনী, খালার চুল ও-ই ড্রেসিং করে। কমলা রঙের কাপড় পরলে নাকি সে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। সেজন্যেই বোধহয় খালি ঝাঁকি খেতে থাকে তার শরীর। আর ওই যে সোনালি-চুলোটা, ওর একটা বড়সড় দোকান আছে, স্বামী হেলথ ডিপার্টমেন্টের বড় অফিসার।
মৃদু একটা শব্দ হলো, কোন দিকে ঠিক বোঝা গেল না। কিশোরের মনে হলো, গ্যারাজে। কী জানি, ঘোড়াটার খুর ঠোকার শব্দ হবে হয়তো!
কিছু একটা ঘটবে, ফিসফিস করে বলল জিনা। চলো, এগিয়ে দেখি।
আরও এগিয়ে আরেকটা ওইসটেরিয়া ঝাড়ের আড়ালে দাঁড়াল ওরা।
একটা কাঁচের বাটিতে পানির মত কী একটা তরল পদার্থ ঢেলে ভ্যারাড়ের দিকে এগিয়ে দিল মিস মারভেল। দুহাতে ধরে বাটিটা তুলল। ভ্যারাড, মোমের শিখার দিকে দৃষ্টি স্থির, কোনরকম ভাবান্তর নেই রক্তশূন্য চেহারায়। সাপের চোখের মত ঠাণ্ডা চোখের তারা চকচক করছে। মোমের আলোয়।
শুরু করা যায়, বলল ভ্যারাড।
টেবিলে আরও কাছাকাছি হলো অতিথিরা। একটা দীর্ঘশ্বাস শুনল বলে মনে হলো কিশোরের।
সবাই আসেনি আজ, গম্ভীর গলায় বলল ভ্যারাড। ডাক্তার শয়তান আজ দেখা না-ও দিতে পারেন। যোজন যোজন দূরে রয়েছেন মহাসর্প, তিনি কথা বলবেন কিনা, তাই বা কে জানে! তবু চেষ্টা করে দেখা যাক।
বাটিটা একবার ঠোঁটে চুঁইয়েই কমলা পোশাক পরা মহিলার হাতে তুলে দিল ভ্যারাড।
আমাদের বৈঠক সার্থক হোক! কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোল জেরি গ্যানারিলের গলা থেকে। বাটিতে চুমুক দিল। হবে, হবে! কেন, সেই যে, বাড়িওলীর সঙ্গে যখন আমার লাগল…
চুপ! ধমক দিল, ভ্যারাড। আবেশই নষ্ট করে দেবেন!
কুঁকড়ে গেল গ্যানারিল, বাটিটা তুলে দিল মিস মারভেলের হাতে। চুমুক দিয়ে খানিকটা তরল খেয়ে সে আবার তুলে দিল রাসলারের হাতে। সে খেয়ে দিল সবুজ পোশাক পরা মহিলার হাতে। তার হাত থেকে আবার বাটি ফিরে এল ভ্যারাডের কাছে।
এবার বসতে পারি আমরা, ভ্যারাড বলল।
যার যার চেয়ার টেনে বসে পড়ল বৈঠকের সদস্যরা।
মিস মারভেল, আপনার ইচ্ছে কী, বলুন, আদেশের সুর ভ্যারাডের গলায়।
মাথা নুইয়ে-অদৃশ্য কারও উদ্দেশে সালাম জানাল মিস মারভেল। আমি ক্রিস্টাল বলটা চাই। অ্যানি পলকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা হোক, কিছুতেই যেন সে ওটা কিনতে না পারে।
বিলিয়ালকে অনুরোধ করব?
করুন। মোট কথা আমি বলটা চাই।
অন্য সদস্যদের দিকে তাকাল ভ্যারাড। আপনাদের কী মত?
আমার নিজের সমস্যা নিয়েই বাঁচি না! ঘোঁত ঘোত করে উঠল রাসলার।
এখানে এক ভাইয়ের সমস্যা সবারই সমস্যা, মনে করিয়ে দিল ভ্যারাড।
অ্যানিকে দূরে কোথাও বেড়াতে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? শরীর ঝাঁকি খেল গ্যানারিলের। এই…দিন পনেরোর জন্যে…কবে পাঠালে সুবিধে, আপা?
একুশ তারিখের আগে, বলল মিস মারভেল।
মিস মারভেলের ওপর থেকে সবুজ পোশাক, তারপর রাসলারের ওপর এসে থামল ভ্যারাডের কালো চোখ। তা হলে আমরা সবাই একমত, চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে।
থিরথির করে কাঁপছে মোমের শিখা। কয়েক মিনিট কিছুই ঘটল না। পাথরের মূর্তির মত নিথর হয়ে আছে ঘরের সব কজন লোক।
শোনা গেল শব্দটা, ঘন কালো রাতের অন্ধকারে ভর করে যেন ভেসে এল। প্রথমে অস্পষ্ট, মোলায়েম একটা কাঁপা কাঁপা আওয়াজ, স্থির বাতাসকে ঘুটছে যেন ধীরে ধীরে। গানের মত, কিন্তু গান বলা চলবে না কিছুতেই, শরীর হিম-করা বেসুরো সুর আছে, কথা নেই; তাল লয় ছন্দ, কিছু নেই। একবার চড়া পর্দায় উঠছে সুর, পরক্ষণেই নেমে যাচ্ছে; একবার তীক্ষ্ণ, একবার মোলায়েম। কমছে, বাড়ছে, থামছে, গোঙাচ্ছে, বিড়বিড় করছে, ফোপাচ্ছে; তারপর হঠাৎ করেই হাঁসফাঁস করে উঠছে, যেন গায়কের গলা টিপে ধরেছে কেউ!
আতঙ্কে রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে তিন গোয়েন্দার। এমন বিচ্ছিরি গান জীবনে শোনেনি ওরা। ভয়ঙ্কর এক কালো জগৎ থেকে উঠে আসছে যেন দুরন্ত শয়তান, মানুষকে টেনে নিয়ে যাবে শব-গন্ধে ভরা নরকে! ঢোক গিলল রবিন, কাঁপা কাঁপা শ্বাস পড়ছে মুসার।