এতে দোষের কিছু দেখছি না, বলল কিশোর।
আমিও দেখতাম না, যদি ওসব চক্র আঁকা আর মোমবাতি জ্বালা বাদ দিত। তা-ও না হয় সওয়া গেল, কিন্তু ওই ভ্যারাড ব্যাটাকে আমি একদম সইতে পারছি না। ও আর ওর বিচ্ছিরি গান!
ছাপার মেশিনের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল মুসা। কিশোর, আমার মনে হয়, ব্যাটাকে তাড়ানো কঠিন কিছু না। ওর বিছানায় শুয়োপোকা ছেড়ে দিতে পারি আমরা, বাথটাবে ব্যাঙ ছেড়ে দিতে পারি, জুতোর ভেতরে সাপ ভরে রাখতে পারি…
না না, ওসবে কাজ হবে না! বাধা দিয়ে বলল জিনা। বরং খুশিই হবে। সাপ ভীষণ পছন্দ ওর! ছুঁচোটার দুর্বলতা কোথায় জানা দরকার।
ওকেও ব্ল্যাকমেইল? শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর।
অনুচিত কিছু হবে না। আমার বাড়িতে ঢুকে বসে অত্যাচার করছে। সে। এমনই চশমখোর, আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না; পাত্তাই দিতে চায় না। যেন বাড়িটা তার বাপের, আমিই অন্যায়ভাবে ঢুকে পড়েছি। ওর ব্যাপারে জানা খুব কঠিন হবে, খালাও মুখ খুলতে চায় না।
হয়তো তোমার খালাও জানেন না, মুসা বলল।
হতে পারে, মাথা ঝোকাল জিনা। নিশ্চয় ভাল জানে। খারাপ কিছু জানলে ব্যাটাকে বাড়িতে ঢুকতে দিত না। খালাটা ভীষণ বোকা, তবে মানুষ খারাপ না। ওসব কথা থাক। আসলে, ভ্যারাডের ব্যাপারে ইনফরমেশন চাই আমি। ও কে, কোথা থেকে এসেছে, কী করে, জানতে চাই। সেজন্যে তোমাদের সাহায্য দরকার। একটু চুপ থেকে বলল, শোনো, আজ রাতে পার্টি দিচ্ছে খালা। টেলিফোনে দাওয়াত করছে, শুনে এসেছি। অতিথিদের খাওয়ানোর জন্যে কী জানি রাধছে ভ্যারাড ব্যাটা। বেশি লোক মানেই বেশি কথা। কিছু না কিছু জেনে যাবই আমরা। পার্টিতে তোমাদেরও দাওয়াত, আমার তরফ থেকে।
ভ্যারাডের রান্না খাওয়ার জন্যে? খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। মুসার।
না, দূর থেকে দেখার জন্যে। ইচ্ছে হলে গন্ধ শুঁকতে পারো যত, খুশি। পার্টি শেষে অতিথিদের অনুসরণ করবে তোমরা; দেখবে, কে কোন্ গুহায় গিয়ে ঢুকছে। তারপর ভাব, কী করা যায়। হ্যাঁ, গ্যারাজের কাছে হাজির থেকে রাত আটটায়। পেছন দিয়ে ঢুকো, তা হলে কারও চোখে পড়বে না। উঠে দাঁড়াল জিনা। ঠিক আটটা, মনে থাকে যেন। নইলে শুঁটকির সঙ্গে দেখা করব গিয়ে, হ্যাঁ।
স্যালভেজ ইয়ার্ডের আঙিনার দিকে চলে গেল ঘোড়ার খুরের শব্দ।
নতুন মক্কেল পাওয়া গেল, কিশোর বলল।
কিন্তু ও যে ব্ল্যাকমেইল…
আরে, দূর, ব্ল্যাকমেইল, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। এভাবে এমন একটা সুযোগ এসে যাবে ভাবতেই পারিনি। রুজ পালিয়ে আসার পর থেকেই ভাবছি, কী করে ঢোকা যায় ও-বাড়িতে। তা ছাপার মেশিনের পেছনে একটা শয়গায় হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একটা লোহার পাত, উঠে গিয়ে ওটা এক পাশে সরিয়ে রাখল কিশোর। বেরিয়ে পড়ল ইয়া মোটা এক পাইপের মুখ। ভিতরে, নিচের দিকে পুরানো কার্পেট ফালি করে কেটে বিছানো; হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় হাতে-হাটুতে ঘা লেগে চামড়া যাতে ছিলে না যায় সে জন্যে। এটা হেডকোয়ার্টারে ঢোকার আরেকটা গোপন প্রবেশপথ, দুই সুড়ঙ্গ। জঞ্জালের তূপের নিচ দিয়ে চলে গেছে পাইপটা, আরেক মাথা শেষ হয়েছে গিয়ে একেবারে ট্রেলারের মেঝের তলায়। মেঝেতে গোল গর্ত কেটে তার মুখে গোল দরজা বসিয়ে দেয়া হয়েছে, ঠেলা দিলেই খুলে যাবে।
ভিতরে যাচ্ছ? জানতে চাইল মুসা।
হ্যাঁ। রবিনের বোধহয় আজ সকালে কাজ নেই লাইব্রেরিতে। ওকে খবরটা দিতে হবে। বলব, আজ রাতে এক পার্টিতে দাওয়াত পেয়েছি আমরা।
আমিও আসি, বলল মুসা। পেরেক আর হাতুড়ি নেব। লাল কুকুর চার বন্ধই করে দিতে হচ্ছে। জিনাকে বিশ্বাস নেই। পান থেকে চুন খসলেই হয়তো গিয়ে বলে দেবে শুঁটকির দলকে, হেডকোয়ার্টারে ঢুকে সব তছনছ করে দিয়ে যাবে ওরা। তার চেয়ে পথ বন্ধই করে দিই আপাতত।
চার
সাঁঝের বেলা পারকার হাউসকে পাশ কাটিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।
পার্টি খুব বড় না, বলল কিশোর। গাড়ি-বারান্দায় মাত্র তিনটে গাড়ি দেখেছে। একটা কমলা স্পোর্টস কার, একটা সবুজ সরকারি গাড়ি, আরেকটা ধূলি-ধূসরিত ছাই রঙের স্যালুন।
বাড়ির পিছনের খানিকটা খোলা জায়গা পেরিয়ে গ্যারাজের পিছনে এসে দাঁড়াল ওরা। ওদের অপেক্ষায় রয়েছে জিনা। নিচু গলায় বলল, সবাই এসে গেছে। ডাইনিং রুমে। চত্বরের দিকের দরজা খুলে রেখেছি, এসো। আস্তে, শব্দ কোরো না।
পা টিপে টিপে এসে দাঁড়াল ওরা চত্বরের ধারে, ওইসটেরিয়া ঝাড়ের ছায়ায়। চোখের সামনে একটা লতা সরিয়ে জিনার কাঁধের ওপর দিয়ে ডাইনিং রুমে উঁকি দিল কিশোর। এমন পার্টি জীবনে দেখেনি সে। পাঁচজন লোক, একটা গোল টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়েছে নীরবে। লালচে-লাল নতুন একটা পোশাক পরেছে মিস মারভেল, আস্তিনের প্রান্ত অস্বাভাবিক ছড়ানো, গলা পুরোপুরি ঢেকে দিয়েছে উঁচু কলার। তার উল্টো দিকের লোকটা হিউগ ভ্যারাড, আগাগোড়া কালো পোশাক পরনে, রূপার ভারি মোমদানিতে জ্বলছে দুটো লাল মোমবাতি, ম্লান আলোয় চকচক করছে লোকটার ফেকাসে চেহারা। ছোট করে ছাটা কালো চুল আঁচড়ে কপালের ওপর এনে ছড়িয়ে ফেলেছে, ঘন ভুরু ছুঁই ছুঁই করছে চুলের ডগা।
ভ্যারাডের বাঁ পাশে ছিপছিপে এক মহিলা, পরনে কমলা রঙের গাউন। মিস মারভেলের মতই চুলে কলপ লাগিয়েছে সে, কিন্তু রঙ পছন্দ ঠিক হয়নি তার। কমলা পোশাকের সঙ্গে হালকা লাল হাস্যকর রকম বেমানান লাগছে।