মুসা এসেছে, মুখ তুলে বলল বোরিস। ওয়ার্কশপে।
ছাপার মেশিন চালু করেছে, রোভার যোগ করল।
মাথা ঝোকাল কিশোর। মেশিন যে চালু হয়েছে, এটা না বললেও চলত। মেরামত করা পুরানো মেশিনের ঘটাং-ঘট ঘটরাং-ঘট এখান থেকেই কানে আসছে। ইসস, ভাঙা একটা আধুনিক মেশিন যদি কোন জায়গা থেকে জোগাড় করতে পারত চাচা!-ভাবল কিশোর, এই বিশ্রী। আওয়াজ থেকে রেহাই পাওয়া যেত।
এক জায়গায় তূপ করা আছে বড় বড় গাছের কাণ্ড; ইস্পাতের কড়িবরগা আর কিছু লোহার জাল। ওগুলো ঘুরে অন্য পাশে চলে এল। কিশোর, স্যালভেজ ইয়ার্ডের মূল আঙিনা দেখা যায় না এখান থেকে, মেরি চাচীর কাঁচে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর ছিমছাম অফিসটাও চোখে পড়ে না। উঁচু কাঠের তক্তার বেড়া দিয়ে ঘেরা পুরো ইয়ার্ড, একদিকের বেড়ার ওপাশেই রাস্তা। কিছুটা জায়গায় বেড়ার মাথায় ছয় ফুট চওড়া চাল, চালের ভার রেখেছে লোহার খুটি। রোদবৃষ্টিতে পুড়ে-ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। যেসব জিনিস, ওগুলো রাখা হয়েছে এই চালার নিচে।
ওয়ার্কশপে ঢুকল কিশোর। ছাপার মেশিনের ওপর ঝুঁকে আছে মুসা, কার্ড ছাপছে। কিছু দিন পর পরই কার্ডের ডিজাইন পাল্টায় কিশোর। কারণ আছে। তিন গোয়েন্দার দেখাদেখি অনেক ছেলেই গোয়েন্দা সাজতে শুরু করেছে; দুই গোয়েন্দা, চার, পাঁচ, ছয়, সাত গোয়েন্দাও গজিয়ে উঠেছে; আগের ছুটিতে টেরিয়ার ডয়েল তো এগারো গোয়েন্দা বানিয়ে বসেছিল। যদিও কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি। একবার তো গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে ডাকাতের ধোলাই খেয়ে এসে পুরো পনেরো দিন বিছানায় পড়েছিল শুঁটকি টেরি আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
ছাপানো কার্ডের তূপ থেকে একটা কার্ড তুলে নিল কিশোর।
মেশিন থামিয়ে ফিরে তাকাল মুসা। কেমন হয়েছে?
খুব ভাল, প্রশংসা করল কিশোর। ভাবতেই পারিনি, এত উন্নতি। করব আমরা, আমাদেরকে নকল করবে লোকে!
চুপ করে রইল মুসা। তিন গোয়েন্দা-র গোড়াপত্তনের সময় ভাবতে পারেনি সে-ও, সংস্থাটা এভাবে টিকে যাবে, কিশোর যখন প্রস্তাব দিয়েছিল, বিদ্রূপ করতেও ছাড়েনি তাকে মুসা। আরও একটা ব্যাপারে ক্ষীণ আপত্তি ছিল তার, কিশোর কেন গোয়েন্দাপ্রধান হবে, মুসা কেন। নয়? তার গায়ে কিশোরের চেয়ে জোর অনেক বেশি, তার বয়েসী যে কোন ছেলেকে পিটিয়ে তক্তা করে দিতে পারে অনায়াসে। কিন্তু কিশোর প্রমাণ করে দিয়েছে, গোয়েন্দা হতে হলে গায়ের জোরের চেয়ে মগজের জোর অনেক বেশি দরকার। রবিনও প্রমাণ করে দিয়েছে, সে একটা চলন্ত বিশ্বকোষ।
তিরিশ ফুট লম্বা একটা মোবাইল হোমের ভেতর তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার। জঞ্জালের তূপের ভেতরে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গেছে। ট্রেলারটা, বাইরে থেকে এর কিছুই দেখা যায় না। ওটা এত বেশি পুরানো আর নষ্ট হয়ে গেছে, মেরামত করেও বিক্রি করা যাবে না, তাই ছেলেদেরকে দান করে দিয়েছেন রাশেদ চাচা। অনেক সময় লাগিয়ে অনেক পরিশ্রম করে ট্রেলারটাকে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছে তিন গোয়েন্দা।
ট্রেলারের ভেতর সুন্দর একটা ল্যাবরেটরি করেছে ছেলেরা। ছবি প্রসেস করার জন্যে ছোট্ট একটা ডার্করুমও আছে। টেলিফোন আছে-তার খরচা ছেলেরাই জোগাড় করে অবসর সময়ে স্যালভেজ ইয়ার্ডে কাজ করে; চাচা-চাচীর কাছে কিশোর চাইলেই টাকা পায়, কিন্তু হাত পাততে রাজি নয় সে। ছোট্ট র্যাকে চমৎকার করে সাজানো রয়েছে। কিছু প্রয়োজনীয় বই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কয়েকটা ফাইল-রবিনের দপ্তর। এ-যাবৎ যতগুলো রহস্যের সমাধান করেছে তিন গোয়েন্দা, সবগুলোর বিস্তারিত রিপোর্ট লেখা রয়েছে ওসব ফাইলে।
আগের কার্ডটার চেয়ে ভাল হয়েছে, কী বলো? মুসা বলল।
হ্যাঁ, হাতের কার্ডটা দেখছে কিশোর। প্রশ্নবোধকগুলো উড়িয়ে। দেয়া হয়েছে, কার্ডের কোণে এখন বড়সড় একটা আশ্চর্যবোধক। এই চিহ্নটাই বরং ভাল। রহস্যময়, অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য বোঝাতে এটাই ব্যবহার হয়, প্রশ্নবোধক দেয়াটা ভুলই হয়েছিল।
হু। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল মুসা, আচ্ছা, জিনাদের বাড়ির কোন খবর আছে?
না, মাথা দোলাল কিশোর। রুজ যাওয়ার পর আর কোন খবর পাইনি। কী শুনে যে এত ভয় পেল সে! সত্যিই শুনেছে, না কল্পনা তাই বা কে জানে! প্রায় বলত, মিস মারভেল অদ্ভুত, কিন্তু কেন এটা মনে হয়েছে তার, বলেনি কখনও।
বলবে আবার কী? সে তো আমরা নিজেরাই দেখেছি। অদ্ভুত না হলে কাটা ক্ষতে মাকড়সার জাল দিতে চায়…
শশশশ! হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল রাখল কিশোর। জঞ্জালের ওপাশে মৃদু একটা শব্দ শুনেছে।
ঝট করে সোজা হলো মুসা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল জঞ্জালের ওপাশে। পরক্ষণেই তার উত্তেজিত চিৎকার কিশোরের কানে এল: তাই তো বলি! ঘোড়ার গন্ধ আসে কোত্থেকে! অনেকক্ষণ থেকেই পাচ্ছিলাম।
গটমট করে এসে ওয়ার্কশপে ঢুকল জিনা, পেছনে এল মুসা। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, বাহ, বেশ জমিয়ে নিয়েছ!
কতক্ষণ আড়ি পাতা হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
অনেকক্ষণ, কারও বলার অপেক্ষায় থাকল না জিনা, একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল, মেশিনটার কাছাকাছি।
কেন? গম্ভীর হয়ে আছে কিশোর।
কার্ডের তূপ থেকে একটা কার্ড তুলে দেখছে জিনা। হুম! হাতখরচ যা পাই, তা দিয়ে প্রফেশনাল ডিটেকটিভ ভাড়া করতে পারব না, মুখ তুলল। তোমার রেট কত?