না না, এর জন্যে ধন্যবাদ আবার কেন? এ তো আমাদের কর্তব্য ছিল, হাসিতে ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে মুসার। আড়চোখে একবার তাকাল বন্ধুদের দিকে
ঘোড়া আনার কাজে সে কোন সহায়তাই করেনি, ভয়ে দূরে দূরে ছিল, সেটা না আবার বলে দেয় ওরা।
ওপরতলায় উঠে গেল জিনা।
শিগগিরই মত বদলাবে ও, বলল মিস মারভেল। যখন ব্যথা কমে যাবে, কালকের মধ্যেই ক্ষত শুকিয়ে যাবে, তখন বুঝবে মলমের গুণ আছে কিনা। বাচ্চা মেয়ে তো, এতবড় একটা ব্যথা পেয়েছে…ও, হ্যাঁ, মেরি চাচীর দিকে চেয়ে বলল মহিলা। আপনারা কে, তাই তো জানা। হয়নি।
মেরি চাচী উঠে দাঁড়ালেন। আমি মিসেস রাশেদ পাশ, ও আমার ছেলে কিশোর। বাইরের লোকের কাছে কিশোরকে নিজের ছেলে বলেই পরিচয় দেন তিনি। ও হলো মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড।
কিশোরকে দেখতে দেখতে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল মিস মারভেলের। দৃষ্টি, বেগুনী চোখের তারায় বিস্ময়। আরে, কিশোর পাশা! মানে, কমিক পাশা?
ঠিকই চিনেছেন, বন্ধুগর্বে আধহাত ফুলে গেল মুসার বুক। ও কমিক পাশা। টেলিভিশনে কমিক দেখিয়ে এই বয়সে এত সুনাম আর কেউ কামাতে পারেনি।
তা, খোকা, সিনেমায় ঢুকছ না কেন? বাচ্চাদের ছবি বানান হলিউডের বিখ্যাত ফিল্ম ডিরেকটর মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার, তাকে গিয়ে ধরো… জানালার বাইরে চোখ পড়তেই থেমে গেল মিস মারভেল। চেঁচিয়ে উঠল, আরে, মিস্টার ভ্যারাড।
ফিরে তাকাল ঘরের আর সবাই। আগাগোড়া কালো পোশাক পরা একজন মানুষ নামছে ট্যাক্সি থেকে। অবাক হলো কিশোর। মানুষের মুখ এত ফেকাসে! সারাজীবন অন্ধকার গুহায় কাটিয়ে মাত্র যেন বেরোল!
হাতে একটা সুটকেস নিয়ে সরু পথ ধরে সদর দরজার দিকে এগোল। লোকটা।
শেষ পর্যন্ত তা হলে এলেন উনি! খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছে মিস মারভেল। আশা পুরো হলো আমার।। আমরা তা হলে আসি, ছেলেদের ঠেলে নিয়ে দরজার দিকে রওনা হলেন মেরি চাচী। চওড়া বারান্দা পেরিয়ে এল ওরা। সরু পথে পাশ। কাটাল আগন্তুককে।
পিকআপে ওঠার আগে থমকে দাঁড়ালেন মেরি চাচী। তোরা তো সাঁতার কাটতে যাবি। এগিয়ে দিয়ে আসব?
না না, লাগবে না, হাত তুলল কিশোর। হেঁটেই যেতে পারব।
যা, এখানে আর থাকিস না! মাথা নাড়লেন তিনি। কাণ্ড! কাটা ক্ষতে মাকড়সার জাল, মাছির ডিম! মেরে ফেলার জোগাড়! গাড়িতে চড়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
মাছির ডিমের কথা শুনিনি, তবে মাকড়সার জালের কথা শুনেছি, বলল কিশোর। বইপত্র প্রচুর ঘাটাঘাটি করে সে, উদ্ভট লেখা দেখলেই তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। রক্ত বন্ধ করতে নাকি খুব কাজ দেয়। পুরানো আমলে লোকে ব্যবহার করত।
পুরানো আমলে তো ছাইপাঁশ কত কী-ই ব্যবহার করত লোকে, মরতও! যত্তসব! গজগজ করতে করতেই ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন মেরি চাচী। গাড়ি পিছিয়ে নিয়ে চললেন গেটের দিকে।
অদ্ভুত! বলল মুসা। রুজ ঠিকই বলেছে। জিনার খালা জানি কেমন!
কুসংস্কার ছাড়তে পারেনি, কিশোর বলল।
সেরাতে ঘুমানোর আগে অনেক ভাবল কিশোর। জিনার খালার বানানো মলমের কথা মনে করে হাসি পেল। অমাবস্যার রাতে শেকড় বাকড় জোগাড় করে…হাহ! হেসে কম্বলটা গলার কাছে টেনে নিল সে। চোখ লেগে এসেছে, এই সময় দরজায় দমাদম কিল পড়তেই তন্দ্রা টুটে গেল।
মিসেস প্যাশাআ! মিসেস প্যাশাআ! দরজা খুলুন!
লাফিয়ে বিছানা থেকে নামল কিশোর, এক টানে ড্রেসিং গাউনটা নিয়ে গায়ে চড়িয়েই দরজা খুলে সিঁড়ির দিকে ছুটল। মাঝামাঝি নেমে গেছেন মেরি চাচী, তার পিছনে রাশেদ চাচা। একেক লাফে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকে চাচা-চাচীর পেছনে চলে এল সে।
দরজা খুলে দিলেন চাচী।
প্রায় হুমড়ি খেয়ে এসে ঘরের ভেতরে পড়ল ক্লজ। আউহহ…মিসেস, প্যাশা! হাঁপাচ্ছে। পরনে শুধু ড্রেসিং গাউন, পায়ে চপ্পল।
কী হয়েছে, রজ? মেরি চাচী অবাক।
আজ রাতটা থাকতে দেবেন? ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল রুজ। মেরি চাচী না বললেই কেঁদে ফেলবে যেন।
রুজ, হয়েছে কী?
গান!
কী?
গান! কেঁপে উঠল রুজ। কিছু একটা এসে ঢুকেছে ও-বাড়িতে, গান জুড়েছে! মেরি চাচীর হাত আঁকড়ে ধরল সে। ভয়ঙ্কর! জিন্দেগীতে ওরকম গান শুনিনি! আমি আর ওখানে ফিরে যাব না!
তিন
আস্তে করে রুজের হাত সরিয়ে দিলেন মেরি চাচী। ঠিক আছে, ফোন করছি আমি।
নাক কোঁচকাল রুজ। তা করুন। কিন্তু আমি আর ওখানে ফিরে যাচ্ছি না।
পারকারদের বাড়ির নাম্বারে রিং করলেন মেরি চাচী। ফোন ধরল মিস মারভেল। সংক্ষিপ্ত কথাবার্তার পর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন চাচী। মিস মারভেল নাকি তেমন কিছু শোনেনি।
ওই বুড়ি তো বলবেই! চেঁচিয়ে উঠল রুজ।
কেন? বলবে কেন?
মানে…ইয়ে…ও, ও নিজেই তো অদ্ভুত! যেসব কাণ্ড ঘটছে ও বাড়িতে, লাখ টাকা দিলেও আর ফিরে যাচ্ছি না।
ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু বলতে চাইল না রুজ, পারকারদের বাড়িতে আর ফিরেও গেল না। রাতটা কিশোরদের বাড়িতে শোবার ঘরে। কাটাল। সকালে গিয়ে রুজের জিনিসপত্র নিয়ে এলেন রাশেদ চাচা, সুটকেস গুছিয়ে দিয়েছে জিনা। তারপর লস অ্যাঞ্জেলেসে রুজের মায়ের। কাছে তাকে পৌঁছে দিতে চললেন।
কী এমন শুনল! রুজ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বলল কিশোর।
কী জানি! হাত নাড়লেন চাচী। নিজের কাজে চলে গেলেন।
পরের কদিন ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবল কিশোর। সেদিন সকালেও একই কথা ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরোল, স্যালভেজ ইয়ার্ডের ভেতরের খোয়া বিছানো পথ ধরে এগোল তার নিজস্ব ওয়ার্কশপের দিকে। কাজে ব্যস্ত দুই ব্যাভারিয়ান ভাই, বোরিস আর রোভার, মারবেলের তৈরি একটা চুলা ঘষেমেজে পরিষ্কার করছে। হলিউড পাহাড়ের ধারে এক পুড়ে যাওয়া বাড়ির নষ্ট জিনিসপত্র কিনে এনেছেন রাশেদ চাচা, চুলাটা ওসবের ভেতর থেকেই বেরিয়েছে।