মোমের অভাব নেই ঘরে। সবুজ, নীলচে-লাল, লাল, সাদা, কালো; যত রঙের পাওয়া যায়, সব আছে।
লাল মোম জ্বালো, বলল আউরো। লাল মানে শক্তি।
মোম জ্বলল।
খবরদার! কেউ কথা বলবে না! হুঁশিয়ার করে দিল আউরো।
কেউ বলল না, আউরো ছাড়া। ভাবি কেমন এক গলায় মন্ত্র পাঠ শুরু করল সে, ভাষাটা বিচিত্র, এক বর্ণও বুঝতে পারল না আর কেউ। সবুজ থলেটা মোমের আলোর দিকে উঁচু করে ধরল; একবার জোরে, একবার আস্তে, একবার ফিসফিস করে, তারপরই নাকি সুরে, কী সব। বকবক করল, সে-ই জানে!
মাথা সামনে-পেছনে তালে তালে দোলাচ্ছে ওঝা, বিড়বিড় করতে করতেই ঝট করে সোজা হয়ে গেল হঠাৎ। গুঙিয়ে উঠে বন্ধ করে ফেলল। চোখের পাতা, গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে হাতের থলে ছাড়েন।
চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে মিস মারভেল। আউরোর মুখ ফাঁক, গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে নানারকম বিচিত্র শব্দ। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে শুরু হলো গান, সেই মহাসর্পের গান! ভাল। করে দেখল কিশোর। উঁহু! আউরোর মুখ থেকে আসছে না আওয়াজ! সারা ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বেসুরো সুর, দুর্বোধ্য শব্দ। জবাই করা ছাগলের মত ঝাঁকুনি খাচ্ছে আউরোর দেহ। হঠাৎ গড়াতে শুরু করল। সে সারা ঘরে। একের পর এক রুমাল খুলে পড়ছে মাথা থেকে, হুঁশই নেই যেন। লম্বা জটাগুলোকে মনে হচ্ছে খুলি আকড়ে থাকা এক ঝাক বিষাক্ত সাপ!
গান বাড়ছে, জোরাল হচ্ছে, আরও জোরাল। তীক্ষ্ণ, বাতাস চিরে কান ফুড়ে যেন ঢুকে যাচ্ছে মগজে।
বিছানায় সোজা হয়ে বসেছে মিস মারভেল। বালিশের দরকার পড়ছে না আর।
প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খেয়ে স্থির হয়ে গেল আউরোর শরীর। মেঝের ঠিক মাঝখানে এসে চিত হয়ে পড়েছে। চোখ খোলা, ছাতের দিকে চেয়ে আছে, প্রাণ নেই যেন।
কিশোর! দরজায় করাঘাত হলো। এই, কিশোর, দরজা খোল! হচ্ছে কী ভেতরে! খোল!
গুঙিয়ে উঠল আউরো। উঠে বসল। থলেটা এখনও হাতে ধরা, এত কিছুতেও ছাড়েনি। সেটার দিকে চেয়ে বলল, দেখেছি ওকে। কালো আলখেল্লা পরা এক লোক, ফেকাসে চেহারা, খুব বিপদে পড়েছে। সাপের। পাকে আটকা পড়েছে সে।
কিশোর, খুললি না এখনও! চেঁচিয়ে চলেছেন মেরি চাচী।
উঠে দাঁড়াল আউরো। মিস মারভেলের কাছে গিয়ে থলেটা বাড়িয়ে ধরল, খুলে দেখো।
কাঁপা হাতে বাধন খুলে থলের ভেতরে হাত ঢোকাল মিস মারভেল। বিস্ময় ফুটল চোখে। মূর্তিটা নেই।
বলেছি না, বিলিয়ালের চেয়ে আমার প্রেত ক্ষমতাশালী? এই প্রথম হাসল আউরো। যে পাঠিয়েছে, তাকেই কামড়াতে গেছে মহাসৰ্প। বিলিয়ালকে ঘুরিয়ে দিয়েছি, জিহাভোকেই আক্রমণ করেছে এখন সে। তোমার আর কোন ভয় নেই।
গিয়ে দরজা খুলে দিল আউরো। কোমল গলায় ডাকল মেরি চাচীকে, এসো, মেয়ে, এসো। আর ভয় নেই। ভূত ভেগেছে।
বাইশ
আশ্চর্য! জিনা বলল। গতরাতে পুরো এক বাটি সুপ খেয়েছে খালা। ঘুমানোর আগে দুধ আর বিস্কুট খেয়েছে। আজ সকালে উঠেই ডিম খেয়েছে দুটো। এই তো, এক ঘণ্টাও হয়নি, খিদে পেয়েছে বলে চিল্লাচিল্লি লাগিয়েছে আবার!
টোস্টার থেকে দুই টুকরো টোস্ট তুলে নিল জিনা। তাতে মাখন মাখাতে মাখাতে বলল, মেরি চাচী না থাকলে কী যে করতাম! জান বেচেছে আমার!
হাসল কিশোর।
আরও দুএকদিন যদি থাকতেন, ট্রেতে টোস্টের প্লেট রাখল জিনা, আর এক গ্লাস দুধ।
দরকার পড়লেই আবার চলে আসবে, কিশোর বলল। ইয়ার্ডে মেলা কাজ পড়ে আছে। চাচীর ধারণা, নিজে হাজির না থাকলে, খালি ফাঁকি দেবে বোরিস আর রোভার। একটু চুপ থেকে বলল, ও, হ্যাঁ, সকালে ক্যাপ্টেন ফ্লেচার এসেছিলেন, লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ চিফ।
কোন খবর? কিশোরের দিকে ফিরল জিনা।
বোমা এনেছিল যে, লোকটা এখন জেলে, রবিন জানাল।
ওর মত লোকের উপযুক্ত জায়গা!
ক্যাপ্টেন বললেন, মুসা জানাল, দুএক ঘা খেতেই মুখ খুলে গেছে। লোকটার। হড়হড় করে বলে দিয়েছে সব। ভ্যারাড আর রড ধরা পড়েছে। রাসলারকে কিছু বলেনি পুলিশ; সে সত্যিই জানত না, বোমা মেরে টারনারের দোকান উড়িয়ে দেয়ার তাল করেছে ডাক্তার জিহাভো।
জিহাভো কই? ধরা পড়েনি?
না, ওই একটাই বাকি, কিশোর বলল।
একটা চেয়ারে বসে পড়ল জিনা। জিহাভো ধরা পড়েনি!
টরেনটি ক্যানিয়নের বাড়িতে পায়নি তাকে পুলিশ। সব কিছু ফেলে পালিয়েছে, এমনকী গাড়িটাও ফেলে গেছে। ক্যাপ্টেনের ধারণা, এতক্ষণে সে পগার পার, এক্কেবারে ক্যানাড়ায়।
চেয়ারের পায়ায় গোড়ালি ঠুকতে শুরু করল জিনা। তোমার কী ধারণা?
এখনও তুমি আমাদের মক্কেল। জিহাভো এভাবে পালিয়ে যাবে, আমার বিশ্বাস হয় না।
ঠিক বলেছ, দরজার কাছ থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।
চেয়ারেই পাঁই করে ঘুরে গেল জিনা। যার যার জায়গায় পাথর হয়ে গেল যেন ছেলেরা।
হলের দিকে পিছন করে দাঁড়িয়েছে ডক্টর জিহাভো। সেরাতে যেমন দেখেছিল, তেমনি দেখাচ্ছে লোকটাকে, সেই একই পোশাক। তবে কাপড়গুলো এখন ময়লা, কোঁচকানো, ধুলো লেগে আছে। হাতে একটা পিস্তল।
আমি একটা গাধা! বিড়বিড় করে নিজেকে গাল দিল জিনা। দরজা খুলে রেখেছি! যে খুশি ঢুকে পড়তে পারে।
কদিন ধরে তো এ-বাড়ির দরজা খোলা দেখছি, একা তোমার দোষ না, লোকটা বলল। বেশি দোষ তোমার ওই মাথামোটা খালাটার।
বাহ, খবর-টুবর ভালই রাখেন, কিশোর বলল। দেখলেন কোত্থেকে? ওই পাহাড়ের মাথায় লুকিয়ে বসে ছিলেন?