টারনারের দোকানের দরজা খুলে একটা ছেলে বেরোল। তার পিছনেই মালিকের মুখ দেখা গেল। আজ আর এসো না।
বড় বড় কদমে কাছে চলে এল কিশোর, দরজায় তালা লাগাচ্ছে টারনার।
সরি, ফিরে চেয়ে বলল লোকটা, বন্ধ করে দিয়েছি।
সাপটা পেয়েছেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ঝট করে সোজা হলো টারনার, মুসাকে চোখে পড়ল। তুমিও আবার এসেছ।
আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই, মিস্টার টারনার, নরম গলায় বলল মুসা।
তাই, না? পুলিশ সব কথা বলেছে আমাকে। তোমরা কিশোর গোয়েন্দা, প্রেতসাধকদের পেছনে লেগেছ। কী বলব? ছেলেমানুষী, না পাগলামি? যা খুশি করো গে। আমি যাচ্ছি। দোকান বন্ধ।
সাপটা পেয়েছেন? একইভাবে জিজ্ঞেস করল আবার কিশোর।
কিশোরের শার্ট খামচে ধরল টারনার। তুমি রেখে গিয়েছিলে? ঘাড় মটকে দেব!
শার্ট ছাড়ানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না কিশোর। আমরা কেউ রাখিনি। তবে জানি, ওটা একটা গোখরোর মূর্তি, কুণ্ডলী পাকানো, চোখ দুটো লাল পাথরের।
স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের মুখের দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ টারনার, তারপর আস্তে করে ছেড়ে দিল শার্ট। আবার দরজা খুলে কাউন্টারের দিকে ইঙ্গিত করল। সাদা ফরমাইকার ওপর বসে আছে মূর্তিটা; মিস মারভেলকে যেটা পাঠানো হয়েছে, তার অবিকল নকল।
মিনিট দুয়েকের জন্যে দোকানের পিছনে গিয়েছিলাম, টারনার বলল। ফিরে এসে দেখি ওটা।
হুঁ! কিশোর গম্ভীর।
আমি যাচ্ছি, তোমরাও কেটে পড়ো। কিছু যদি ঘটেই, নির্জন জায়গায় ঘটুক। পুলিশকে ফোন করে জানিয়েছি। যাও যাও, সরে যাও।
রাস্তা পেরিয়ে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল। কাঁধ ধরে এক ঝটকায় তাকে আবার রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে দিল টারনার। বাড়ি যাও! তোমার মাকে বলবে, সে-ও যেন আজ আর না বেরোয়! যাও!
হাঁ করে টারনারের দিকে চেয়ে রইল মেয়েটা।
দেখছ কী! ধমকে উঠল দোকানদার।
কিছুই না বুঝে প্রায় ছুটে পালাল মেয়েটা।
খদ্দেরের জ্বালায় আর পারি না! আক্ষেপ করল, টারনার। একেবারে উইপোকা! ঝাঁকে ঝাকে আসে, ছাড়াতে পারি না!
দালানের কোণের দিক থেকে একটা লোক এসে দাঁড়াল। নীল প্যান্ট আর কালো কোটের বয়েস কত সে নিজেও বলতে পারবে না হয়তো। ময়লা, ছেঁড়া, কোঁচকানো কাপড়-চোপড়। অনুনয় করল, কফি হবে?
আগ্রহের সঙ্গে লোকটাকে দেখছে জিনা। জীবনে ভিখিরি খুব কমই দেখেছে সে, এই লোকটা তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। গায়ে শুধু কোট, শার্টও নেই। লালচে ঘাড় বেরিয়ে আছে। কতদিন চুল কাটেনি, কে জানে! ধুলোয় ধূসর, শিগগিরই পরিষ্কার না করলে জটা পড়বে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে।
হবে, ভাই? আবার অনুনয় করল লোকটা। এক-আধটা স্যাণ্ডউইচও যদি পেতাম! দুদিন খাইনি!
পকেট থেকে নোটের তাড়া বের করে একটা খুলে নিল টারনার। লোকটার দিকে না তাকিয়ে বাড়িয়ে ধরল, নোটটা। আমার দোকান বন্ধ। ওই যে, ওই দোকান থেকে কিনে খাও গে, রাসলারের দোকান দেখিয়ে দিল।
ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন! টাকাটা নিয়ে কপালে ছোঁয়াল ভিখিরি। ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েই খবরের কাগজ রাখার স্ট্যাণ্ডে হোঁচট খেল, সামলানোর চেষ্টা করল, পারল না, স্ট্যাণ্ড আর কাগজগুলো নিয়ে পড়ল হুড়াম করে।
আরে, দূর! চেঁচিয়ে উঠল টারনার। জ্বালা!
হাঁচড়ে-চড়ে কোনমতে উঠল ভিখিরি। সোকে! (ইটস ওকে) টলতে টলতে পা বাড়াল।
এই, মিয়া! জিনা ডাকল। দাঁড়াও! এগিয়ে গিয়ে উবু হয়ে ছোট একটা কালো বাক্স তুলে নিল। তোমার রেডিও ফেলে যাচ্ছ!
দৌড় দিল লোকটা।
জিনা! হাত বাড়াল কিশোর। জলদি দাও আমার হাতে!
গুড লর্ড! চেঁচিয়ে উঠল টারনার। ছোঁ মেরে জিনার হাত থেকে বাক্সটা নিয়েই ছুঁড়ে ফেলল অন্ধের মত। উড়ে গিয়ে রাসলারের দোকানের দেয়ালে বাড়ি খেল ওটা, ভ্রামমম্ করে বিকট আওয়াজ তুলে ফাটল। চোখ ধাঁধানো আলো। কালো ধোঁয়া সরে যেতেই দেখা গেল, রাসলারের দোকানের জানালা-দরজার একটা কাঁচও নেই, সব গুড়ো। রাসলারের নোংরা ফেকাসে মুখটা চকিতের জন্য দেখল কিশোর।
ক্ষণিকের জন্য থ হয়ে গিয়েছিল টারনার, সংবিৎ ফিরে পেয়েই ঘুরে তাকাল। পথের মোড়ের কাছে চলে গেছে ভিখিরির পোশাক পরা লোকটা। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল টারনার সেদিকে।
বোমা! থরথর করে কাঁপছে এখনও জিনা। জীবনে দেখিনি! আমি ভেবেছি রেডিও!
মাই ডিয়ার লেডি, হাসিমুখে বলল মুসা, আমাদের সঙ্গে থাকলে আরও অনেক কিছুই দেখবে। সারাজীবন ঘরের ভেতরেই কাটিয়েছ
জিনার ওপর থেকে রাগ দূর হয়ে গেছে ছেলেদের।
বিশ
ফেরার পথে পিকআপের পিছনে বসল জিনা। এক সময় বলল, আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না। এবার নিশ্চয় খালার সঙ্গে কথা বলবে পুলিশ।
ভদ্রভাবেই বলবে, জিনার আশঙ্কা দূর করতে চাইল কিশোর। তিনি তো আর অপরাধী নন।
পুলিশের ঝামেলা থেকে যদি দূরে সরিয়ে রাখা যেত!
সম্ভব না, মাথা নাড়ল রবিন। তা ছাড়া পুলিশের কাছে চেপে রাখাও আর উচিত হবে না আমাদের। ভয়ানক লোক জিহাভো, মানুষ খুন করতেও বাধে না তার। আজ আরেকটু হলেই তো দিয়েছিল টারনারকে শেষ করে!
জিনা, আজ একটা কাজের কাজ করেছ, মুসা বলল। বোমাটা আমাদের চোখে পড়েনি, তুমি না দেখলে… হাসল সে। এত তাড়াতাড়ি চলে আসা উচিত হয়নি। লোকটাকে ধরতে পারলে ধোলাই যা একখান দেবে না টারনার! আহ, থাকলে পারতাম!